মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ঃ চুয়াডাঙ্গায় প্রবাসী সরকারের শপথ বাতিল করা হয়। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্হায়ী রাজধানী করা হয়। মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিন নির্ধারণ করা হয়। রাজধানীর বিষয়টি সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ডা.আসহাবুল হক এমপিএ আনন্দের সাথে দেশি বিদেশী সাংবাদিকের নিকট প্রকাশ করে ফেলেন। আকাশবাণীও বিষয়টি গোপন রাখেনি। রাজধানির গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার পর পাকিস্তানি বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় মুক্তি বাহিনির সদর দপ্তর ধ্বংস করে দেয়। মুক্তি বাহিনি পিছু হটার পর ১৪ তারিখে ধার্য শপথ গ্রহনের স্থান পরিবর্তন করে নেয়া হয় মেহেরপুরের সীমান্তে বৈদ্যনাথ তলায় যা আজ মুজিব নগর।
এখানেই স্বাধীন দেশের রেডক্রস জন্মলাভ করে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। বাংলাদেশ নাম দিয়ে টেলিফোন চালু হয় এখানেই। প্রথম রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম ও সিলমোহর তৈরি হয়েছে চুয়াডাঙ্গা থেকেই। প্রথম সরকারী পরিপত্র জারী করা হয় এখান থেকে। অবশ্য তখন প্রবাসী সরকার গঠন হয়নি কিন্তু তাজউদ্দিন এর সম্মতি ছিল। মেজর আবু ওসমান ঐ পরিপত্রে এসপি মাহবুব এসডিও তৌফিক এলাহি চৌধুরী এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিউল্লাহ কে ক্যাপ্টেন পদে আত্তীকরণ করেন। মেজর আবু ওসমান বিদেশী সাংবাদিকদের ভিসা মঞ্জুর করেন এখান থেকেই।
এদিন ছুটি ভোগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর জিয়া তাকে মহালছড়ি পাঁঠিয়ে দেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ ২০০ সৈন্য নিয়ে মহালছড়িতে মীর শওকতের সাথে যোগ দেন। খাগড়াছড়ি এলাকাতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি মাইনাস (১০০ জন), বুড়িঘাটে একটি কোম্পানি মাইনাস (১০০) নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, বরকলে লে. মাহফুজ একটি কোম্পানি মাইনাস (১০০) নিয়ে এবং কুতুবছড়ি এলাকাতে সুবেদার মুতালেব একটি কোম্পানি মাইনাস(১০০) নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে,বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত এক ভাষণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিশ্বের সকল বার্তাজীবী এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। তিনি সকল বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, যথা রেডক্রস ইথ্যাদির প্রতি সরাসরি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান।
ঢাকার মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার শপথ ঘোষণা করে হানাদার ও সহযোগীরা।
সারাদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পাকহানাদার বাহিনী বিমান আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি আশুগঞ্জেও পাকবাহিনী বিমান আঘাত হানে। এই আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বহু নিরীহ মানুষ ও বাঙালি মুক্তিকামী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বিগ্রেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনী উজানিসার ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য নিহত হয়।
সারাদিন মধুপুর গড়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকসৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে কালিহাতি ও ঘাটাইল অঞ্চলে অবস্থান নেয়।
প্রথম রেজিমেন্ট চৌগাছা থেকে হেড কোয়ার্টার তিুলে নিয়ে বেনাপোলের ৩ মাইলপূর্বে কাগজপুকুর গ্রামে স্থাপন করে এবং যশোর বেনাপোল রাস্তার দুধারে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
দিনাজপুরের খানসামা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নীলফামারী থেকে আগত পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হঠাৎ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটে।
ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ পাকসেনারা আক্রমণ করে এবং আগুনে বোমার সাহায্যে পঞ্চগড় শহরকে সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে অমরখানায় ডিফেন্স নেয়।
সকাল ৯টায় পাকবাহিনী কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এসে জেলখানার উত্তরে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকসেনারা জেল অফিসে কর্মরত হেড ক্লার্ক ও সিপাইসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে।
রাজশাহী শহরের লক্ষীপুর গার্লস স্কুলের সামনে পাকসৈন্যরা মোশারফ হোসেন সন্টুসহ ৩০ জনকে সমবেত করে। এদের মধ্য থেকে মঈনউদ্দিন আহমদ মানিক, আশরাফ হোসেন রতন ও মাসুদ রানা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে পালায়। বাকী সবাইকে পাকহানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মোশারফ হোসেন সন্টু লাশের নীচে চাপা পড়ে আহত অবস্থায় বেঁচে যান।
পাকবাহিনী সান্তাহার পৌঁছালে বিহারীরা হানাদারদের সাথে মিলিত হয়ে আশেপাশের গ্রামগুলো ঘেরাও করে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অগনিত মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সান্তাহার গণহত্যা’ নামে পরিচিত।
পাকবাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজারহাট ও কুলারহাট অবস্থানের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা স্থান দুটি ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে।
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি, বুড়িঘাট ও রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, রাঙ্গামাটি ও বরফকলের মধ্যস্থলে লে. মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে এবং কুতুবছড়ি এলাকাতে সুবেদার মুতালেব একটি কোম্পানি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড যুদ্ধের পর কুমিল্লার কসবা পাকিস্তান সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়।
মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে পাকশী সেতুর কাছে তীব্র সংঘর্ষ হয়।
নিউয়র্ক টাইমসের ভাষ্য: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মতো শহরে এখন সম্ভবত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোক রয়েছে। সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে সেনাদলের সামরিক আক্রমণে যারা বেঁচে গেছেন তারা প্রায় সবাই প্রতিরোধকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও সংগ্রামের নোটবুক।
সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।