শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারী করোনা আক্রান্ত বিশ্বে একটা কথা পরিষ্কার: মুক্ত বাজার অর্থনীতি সকল মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। এতদিনের বাজার অর্থনীতির পক্ষে গাওয়া বিশ্বায়নের গান শুধুই সামান্য কিছু মানুষের উন্নতি করার পথ দেখিয়েছে। কিন্তু এবার পুঁজি নিজেকে বাঁচতে ঘুরে দাঁড়াবে কোন পথে? লক্ষ কোটি বিলিয়ান ডলার প্রশ্ন এটাই। এরকম সঙ্কট আগে কোনও দিন হয়নি। ২০০৮-এর মন্দা আর এবারের মন্দার পিছনে দু’টি আলাদা কারণ, চরিত্র তাই এক নয়, অর্থনৈতিক কাজকর্ম কমে যাওয়ার পরিমাণও স্তর ভেদে ভিন্ন। তাই সমাধান একই ফর্মুলায় বা একই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হবে না। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ফিনান্স ক্যাপিটাল দেউলিয়া হয়, তাই ভাবা হয়েছিল নতুন করে আরও পুঁজি ঢাললেই আর্থিক ক্ষেত্র শুধরে যাবে। এবারের আক্রমণটা আরও গভীরে। গোটা বিশ্ব অর্থনীতিই বিচ্ছিন্ন। প্রতিটা দেশ নিজেরাই কী করে টিকিয়ে রাখবে তাদের ব্যবস্থা তার আশঙ্কায়।
বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াটাই স্তব্ধ ।
মোকাবিলা তাহলে কোন পথে কীভাবে হবে? সেটা আরও কোটি কোটি বিলিয়ান ডলারের প্রশ্ন? কে দেবে ভর্তুকি? নিত্য রাহাজানি খরচ? দিতে হবে সেই সরকারকেই। তাহলে কেন বলা হয় বাজার থেকে রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে নিক। বিপদের সামাল দেবে সরকার, ক্ষতির মাশুল দেবে সরকার, তারপর বিপন্ন উন্নয়নশীল দেশকে ধার দেওয়ার ব্যবসা করবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, মার্কিন জোটের লবি, চীন, জাপানের মতো উন্নত দুনিয়া। সুদে আসলে তাদের ধার শোধ করতে কমপক্ষে ৬০% খরচ বাড়বে সর্বস্তরে। তাহলে কোথায় পেল সাধারণ মানুষ বিশ্বায়নের সুফল?
বিশ্বায়ন শুরু হয়েছিল এক দেশে কম খরচে বানিয়ে অন্য দেশের বাজার পাওয়ার জন্য। করোনা-পরবর্তী সময়ে সেই কম খরচে উৎপাদনের সুযোগ কমে যাচ্ছে, অথচ বাজার বাড়বে না। সর্বোপরি সরকারকে সরিয়ে বেসরকারি পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে (বাজারের অদৃশ্য শক্তিকে মান্যতা দিয়ে) যেভাবে উন্নয়নের ডিসকোর্স রচনা করা হয়েছিল, সেই তত্ত্বের গোড়ায় আক্রমণ করল বর্তমান পরিস্থিতি। শেষে বেসরকারি পুঁজিকে সুসময়ে লালন পালন আর দুঃসময়ে বাঁচাতে আসতে হচ্ছে জনগণের টাকা দিয়েই। রাষ্ট্রকেই বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে বাজার। তাহলে বিশ্ব লগ্নি পুঁজির সপক্ষে রচিত বিশ্বায়নের ভাবনাটাই তো বদল করা দরকার।
চ্যালেঞ্জের মুখে এখন সেইসব অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যা এতদিন ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের পথ প্রশস্ত করে সামাজিক কল্যাণের রাস্তা বন্ধ করেছিল। অর্থনীতির উপরতলার থেকে উদ্বৃত্ত ও সঞ্চয় চুঁয়ে পড়ার তত্ত্ব কতটা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থান বাড়াতে পেরেছে? করোনা আক্রমণের আগেই ভারতে তথা সারা বিশ্বে বেকারত্ব চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অকল্যাণকর, পরিবেশ বিপন্ন করে গণ উন্নয়নকে বাধা দেয় যে-পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, তাতে যে গোটা মানবসমাজ বিপন্নই হয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল করোনা। এখন সেই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হচ্ছে দেশের মানুষকে বাঁচাতে।
তাহলে বেসরকারিকরণের ধ্বজা ওড়ানোর আদৌ কোনও যুক্তি আছে কি? বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা লকডাউন সামাল দিতে না-পেরে দেউলিয়া ঘোষণা করে সরকারি সাহায্য চাইছে কোটি কোটি বিলিয়ান ডলার। বলা হচ্ছে, ছোট বড় সব ধরনের পুঁজিকে যত রকমে সম্ভব ঘাটতি পূরণের সাহায্য দিতে। কেন? দেওয়া হবে কেন? জনগণের করের টাকায় সাহায্য না দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই তাহলে সেই সংস্থাগুলি অধিগ্রহণ করে চালানো হোক। প্রতিযোগিতার বাজারে যদি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে পাল্লা দিতে না-পারলে রাষ্ট্রীয় সংস্থার ক্লোজার মেনে নেওয়া যায়, তাহলে কেন এবার সরকারের টাকায় সরকারের সংস্থা না চালিয়ে রুগ্ন, দেউলিয়া বেসরকারি সংস্থাকে অক্সিজেন দেওয়া হবে? আর সেটা করতে গিয়ে কেন দেশের সরকারের কোষাগার ক্রমশ ফাঁকা হতে হতে গোটা দেশটাই দুর্বল হবে?
আজ এই প্রশ্নের মুখে খোদ যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে সকলেই যে বাজারসর্বস্ব অর্থনৈতিক নীতি কীভাবে সরকার ও জনগণকে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব করছে। এই করোনার প্রকোপ এতটা তার কারণ তাদের সরকারের বাজারি নীতিতে নেই সাধারণ মানুষের জন্য সস্তায় স্বাস্থ্য, নেই সামাজিক সুরক্ষা। কোষাগারে শত কোটি বিলিয়ান ডলার নিয়েও নিজের দেশের মানুষের জন্য বিনামূল্যে তো দূরের কথা, সস্তাতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। হার্ভার্ড-এর গবেষক থেকে মার্কিন মিডিয়া এখন সকলেই বলছেন, আমেরিকার এই মারাত্মক পরিণতির জন্য দায়ী জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিরোধী লগ্নি পুঁজির বাজারি অর্থনৈতিক নীতি।
শুধু শুধু বাজার থেকে সরে যাওয়ার সমন দেওয়া হয় সরকারি সংস্থা আর দুর্বল মানুষকে। যেন ভাবটা এই যে, তোমার যোগ্যতার অভাব, তাই তুমি টিকতে পারবে না, তার দায় কেন রাষ্ট্র নেবে? অথচ এই যুক্তি ভুলে লালন পালন করা হয় বেসরকারি লগ্নি পুঁজিকে। দেশের বিপদে তারা সামান্যই ভূমিকা নেয়।
পুঁজিকেও যদি টিকতে হয় তবে বুঝতে হবে নিজেকে ঠকানোর দিন শেষ। বাজারের শক্তিই যদি নিরূপক হয় তাহলে তার জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ নীতি। ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’ নীতিতেই পলায়নপর বেসরকারি পুঁজিকেও তাহলে সরে যেতে হবে। সেই জায়গা পুনর্দখল করুক রাষ্ট্র, তাতে রাষ্ট্র ও জনগণ কেউই বঞ্চিত হবে না। চীন কিন্তু সেটা করেই আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হতে পেরেছে। সে-দেশে বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহ দেওয়ার মানে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থাও কাউকে জায়গা ছেড়ে দেয় না। মার্কিন ও সব ইউরোপীয় সরকার পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই তাদের বাজারও নিচ্ছে চীন।
পুঁজি ও সর্বস্তরের মানুষের শ্রমের উৎপাদনশীলতা সর্বোচ্চ করে রাষ্ট্রকে সামনে রেখে করোনা-পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক নীতি নিতে হবে। দুঃখের বিষয়, কোনও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, মার্কিন মদতপুষ্ট অর্থনীতির প্রবক্তারা এই কথা বলবেন না, কারণ তাঁদের গবেষণার বিষয় ও বক্তব্য একটাই: যেভাবে সম্ভব রাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় করে বেসরকারি পুঁজির মুনাফা বাড়ানো। রাষ্ট্রকে শুষে বাজার দখল—এটাই তাদের এক তরফা এজেন্ডা। এতদিন তাই তাঁরা বলে এসেছেন, রাষ্ট্রকে গুটিয়ে নিতে, বাজারের অদৃশ্য শক্তির হাতে ছেড়ে দিতে হবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ!
আজ করোনা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছে কত বড় ভুল ছিল এই নীতি। তার জন্যেই আজ বিপন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বর্তমান বাস্তবতা ছুঁড়ে দিয়েছে পাল্টা প্রশ্ন: আজ যদি রাষ্ট্র না-থাকে তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? পুঁজি কী করে বাজার ফিরে পাবে? সেইজন্যই তো বলা হচ্ছে, চাহিদা বাড়াতে সরকারি অর্থ ঢেলে সবকিছু সচল রাখার কথা। তার জন্য লাগবে শত শত ট্রিলিয়ান ডলার! কে দেবে? দেবে তো সেই রাষ্ট্র, থুড়ি, টাকাটা তো শেষমেশ আসবে সেই তো জনগণের পকেট থেকেই!
করোনা-পরবর্তী বিশ্বায়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত, তাই সর্বাগ্রে পরিবেশের উন্নয়ন, সর্বস্তরের পিছিয়ে-পড়া মানুষকে এগিয়ে এনে অসাম্য কমানো এবং উৎপাদনশীলতার নিরিখে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বাজারের সম্প্রসারণ। কর্পোরেট বোর্ড রুম থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাঙ্কঋণের নামে জনগণের টাকায় ব্যবসা করা আর নয়; সরকারি সংস্থাকে রাজনৈতিক কৌশলে সরিয়ে মুনাফা বাড়িয়ে বাজারকে কুক্ষিগত করার নীতিতে উন্নয়ন স্থায়ী হয় না । কবির অনুকরণেই আজ তাই বলতে হচ্ছে: ও পুঁজি তোর বাজার কোথায়? আসল কথা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। নিরবিচ্ছিন্ন বিকাশের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চাই। কেবলমাত্র দুর্বল শ্রেণীর মানুষকে দু’-চার মাস ফ্রি সাহায্য দিয়ে, দেশ বা বাজার কোনওটাই গড়ে ওঠে না।