বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমনটি আশংকা করেছিল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় করোনা ভয়ঙ্কর রুপ নিবে, বাস্তবে তেমনটি হয়নি। বাংলাদেশ, এমন কি ভারত করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। করোনার লগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, লক ডাউনসহ কিছু ব্যবস্থার কারণে এই তিনটি দেশ করোনা সংক্রমণের যে ভয়াবহ ঝুঁকি তা থেকে নিজেদের আপাত রক্ষা করতে পেরেছে।তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, এখনো করোনার ভয়াবহতা থেকে মুক্ত হয়নি দেশগুলো।করোনা সংক্রমণ এই দেশগুলোতে যে কোন সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু মাইলফলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে সিদ্ধান্তের ফল বাংলাদেশ পেয়েছে। সীমিত আকারে সামাজিক সংক্রমণের মধ্যে করোনাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে। এই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে;
সরকারী উদ্যোগে রক্ত পরীক্ষা
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা শুধুমাত্র সরকারী উদ্যোগেই করোনা পরীক্ষা করেছে।এমনকি পাশের দেশ ভারত এটা বেসরকারী খাতে দিয়েছে।তিন হাজার রুপিতে বেসরকারী হাসপাতালগুলো করোনা রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এটিকে শুরু থেকে আলাদা করেছে। বিনামুল্যে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে এবং সরকারী উদ্যোগ এবং খরচেই ২০ থেকে ২১ টি জায়গায় রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। এর ফলে দরিদ্র মানুষ যেমন করোনার উপসর্গ দেখলে পরীক্ষা করাতে পারছে। দ্বিতীয়ত, এর ফলে ভুল তথ্য এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলো করোনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে না।
চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতাল
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসা করা হচ্ছে সরকারী উদ্যোগে। সরকার শুরু থেকেই অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও পৃথক হাসপাতাল করেছে। এরফলে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিছু মানুষ তথ্য গোপন করে সাধারণ হাসপাতালে গেছে, সেখান থেকে করোনা সংক্রমণ হয়েছে। এখান থেকেই বোঝা যায়, যদি সাধারণ হাসপাতালগুলোতে সমান্তরালভাবে করোনার পরীক্ষা এবং করোনার চিকিৎসা দেওয়া হতো তাহলে পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ হতো। সেই ভয়াবহতা এড়াতে আমাদের সীমিত সুযোগ, অপ্রতুল সেবা ব্যবস্থা থাকলেও করোনা সংক্রমণ ব্যপক ঝুঁকিকে রোধ করেছে।
সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে ক্লাস্টার বিচ্ছিন্ন করা
বাংলাদেশে শুরু থেকেই সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল।বিশেষ করে ইউরোপ থেকে ফেরতরা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশে সামাজিক সংক্রমণের এক মস্ত ঝুঁকি তৈরী করেছিল। এ ক্ষেত্রে সরকার শুরু থেকেই সামাজিক সংক্রমন ঠেকাতে ক্লাস্টারগুলোকে চিহ্নিত করেছে। ক্লাস্টারগুলোকে লক ডাউন বা বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক সংক্রমণ সংকুচিত করেছে। যখন টোলারবাগে করোনা রোগী পাওয়া যায় সাথে সাথে তা লক ডাউন করা হয়। এমন করে যে বাড়ি বা এলাকায় করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেছে সাথে সাথে লক ডাউন বা বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে সাথে সাথে সংক্রমণের গতি প্রবাহ রোধ করা হয়েছে। এটা বেশ ভালো ও বিরল একটি উদ্যোগ ছিল, যে কারণে বাংলাদেশ ইউরোপ বা আমেরিকার মত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।
চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়া
বাংলাদেশে যখন করোনা সংক্রমণ শুরুই হয়নি, তখন থেকে চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা কিংবা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, ভীড় এড়ানোর মতো সামাজিক সচেতনতার কিছু প্রভাব করোনা সংক্রমনে পড়েছে। এরফলে করোনার যে ব্যপক বিস্তৃতি তা রোধ করা গেছে।
ধাপে ধাপে চিকিৎসা পদ্বতি
বাংলাদেশের যে পদ্বতি সারা বিশ্বের জন্য রোল মডেল হতে পারে তা হলো ধাপে ধাপে চিকিৎসা। প্রথমত যারা বিদেশ ফেরতদের সংক্রমণে এসেছে বা বিদেশ থেকে এসেছে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা। দ্বিতীয়ত, যাদের উপসর্গ দেখা গেছে তাদের আইসোলেশনে রাখা। তৃতীয়ত, যখন মৃদু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তখন তাদেরকে বাসায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
হাসপাতাল নির্ভর চিকিৎসা না করে ধাপে ধাপে এই চিকিৎসা পদ্বতি বিশ্বে একটি নতুন রোল মডেল হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই ফল খুব ইতিবাচক বলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এমনকি সামাজিক দূরত্ব কিংবা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রতিপালিত হয়নি। তারপরও এই ৫ টি মাইলফলক সিদ্ধান্ত প্রতিফলনের কারণে বাংলাদেশ ব্যাপক করোনা সংক্রমণ এবং করোনা মহামারি থেকে মুক্তির একটি পথ দেখছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।