কালের পরিক্রমার পথ ধরে মুসলিম উম্মাহর কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অমিয় বার্তা নিয়ে আবার শুভাগমন করলো পবিত্র মাহে রমজান। দীর্ঘ এগারটি মাসের পাপ পঙ্কিল থেকে মুক্ত হওয়ার অপূর্ব সুযোগ এনে দেয় এই রমজান।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা মোত্তাকি হতে পার।’ (সূরা বাকারা : আয়াত নং-১৮৩)।
রমজানঃ রমজান বলতে রমজান মাসকে বোঝানো হয়। রমজান মাস আরবি বারো মাসের মধ্যে নবম মাস। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মাস। রমজান শব্দটি আরবি ‘রামজুন’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তপ্ত হওয়া, দগ্ধ হওয়া,পুড়ে যাওয়া ইত্যাদি। রোজার মাধ্যমে যেরূপ মানুষের কুপ্রবৃত্তি জ্বলে-পুড়ে যায় তেমনি ক্ষুধা বা পিপাসার জ্বালায় তার পেট উত্তপ্ত ও দগ্ধ হয়ে যায়, তাই একে রমজান বলা হয়।
রোজাঃরোজা ফারসি শব্দ। এর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। আর ‘সাওম’-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ক. কাজ থেকে বিরত থাকা, খ. কঠোর সাধনা করা, গ. অবিরাম প্রচেষ্টা, ঘ. আত্মসংযম ঙ. খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। আর ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, ‘সাওম’ তথা রোজা হলো সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
রোজা ফরজ হওয়ার হেকমত ও উপকারিতাঃ ইসলামী শরিয়তে রোজার বিধান প্রবর্তনের পিছনে বহু হেকমত, উপকারিতা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিদ্যমান। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
১. রোজার মাধ্যমে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জিত হয়। ২. রোজা মহাপ্রভুর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। ৩. রোজার মাধ্যমে অফুরন্ত রহমত লাভ করা যায়। যেমন হাদিসে এসেছেÑ রমজানের আগমনে রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম। যেমন হাদিসে এসেছেÑ রমজানের আগমনে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। ৫. রোজা দ্বারা ব্যক্তির চরিত্র বিধ্বংসী কুপ্রবৃত্তি দমন হয়। ৬. রোজা দ্বারা ব্যক্তির চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা ও লজ্জাস্থান প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অতিরিক্ত চাহিদা অবদমিত হয়। ৭. রোজার মাধ্যমে ব্যক্তি কুপ্রবৃত্তি ও প্রলোভনের ওপর জয়ী হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সক্ষম হয়। ৮. রোজা দ্বারা অন্তরের যাবতীয় মলিনতা ও কুটিলতা দূর হয়। ৯. রোজা ব্যক্তিকে যাবতীয় অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত করে তোলে। ১০. রোজা শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। যেমন হাদিসে এসেছে- ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ ১১. রোজার কারণে ক্ষুধার অনুভূতি ধনীর অন্তরে দরিদ্রের জন্য সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং দরিদ্রকে সাহায্য করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। ১২. রোজার মাধ্যমে ক্ষুধার তীব্র পীড়নে জর্জরিত গরিবদের প্রতি ধনীদের অন্তরে বেদনার অনুভূতি জাগ্রত হয়। ১৩. রোজা পালনের মাধ্যমে অতীতের গুনাহগুলোর ক্ষমা পাওয়া যায়। যেমন- হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছেÑ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় রোজা পালন করে, তার পূর্বাপর গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ ১৪. রোজা বিশ্বমুসলিম সমাজে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সৃষ্টি করে। ১৫. রোজার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিসহ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও নম্র স্বভাবের গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। ১৬. রমজান হলো কুরআন নাজিলের মাস। কুরআনের আলোকে সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা জোগায় পবিত্র মাহে রমজান। ১৭. রোজা জান্নাতে প্রবেশের এক উত্তম মাধ্যম। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, তন্মধ্যে একটি দরজার নাম হচ্ছে ‘রাইয়্যান’। এটি দিয়ে একমাত্র রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন।” ১৮. স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। যেমন হাদিসে কুদসিতে এসেছে- ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেবো।’ ১৯. পাপাচার ও অবাঞ্ছিত কাজ হতে বিরত রাখে। ২০. স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত করে। ২১. বিভিন্ন রোগজীবাণু ধ্বংস ও শারীরিক সুস্থতা আনয়ন করে। ২২. মানসিক প্রশান্তি লাভের অন্যতম মাধ্যম। ২৩. রোজাই মানুষকে আল্লাহ ও বান্দার অধিকার আদায়ে যোগ্য করে তোলে। পরিশেষে বলা যায়, বান্দাকে সঠিক ও সরল পথে পরিচালিত করার জন্য রোজা হচ্ছে সঠিক এঁরফব ষরহব. সার্বিক দিক থেকে সংযম হওয়ার মাধ্যমে মানুষের চরিত্র গঠনের এক অনন্য পন্থা।
রোজার মাসের মর্যাদাঃরোজার মাস হলো রমজান মাস। এটি হচ্ছে আরবি বারো মাসের মধ্যে নবম মাস। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মাস। কুরআন ও হাদিসের আলোকে এটি সম্মানিত মাস হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-
১. কুরআন নাজিলের মাস : পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকা কুরআন মাজিদ নাজিল করেছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- ‘রমজান মাস হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে এ মাসটি পাবে, সে যেন তাতে রোজা রাখে।’ (সূরা বাকারা : আয়াত নং-১৮৫)।
২. বরকতময় মাস : মাহে রমজান বরকতময় মাস। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে- ‘হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাছে রমজান আসছে। এটি বরকতময় মাস। এ মাসে রোজা রাখা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন। এ মাসে আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুষ্টু শয়তানকে বন্দী করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যার মর্যাদা হাজার মাস অপেক্ষা বেশি। যাকে সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়, সে প্রকৃত বঞ্চিত।” (সুনানে নাসায়ী)।
৩. মাহে রমজানে ইবাদতের তাৎপর্য অত্যধিক : এ মাসের ইবাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে আছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ কাজ করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ কাজ করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ কাজ করল।’ (বায়হাকি)।
৪. মাহে রমজানে বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হয় : রমজান মাসের আগমনের সাথে সাথে বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। যেমন হাদিস শরিফে বর্ণিত রয়েছে- ‘যখন রমজান আসে, তখন তার (সম্মানে) রহমতের (বেহেশতের) দরজা খুলে দেয়া হয় এবং দোজখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দী করা হয়।’(সহিহ মুসলিম)
৫. মাহে রমজানে ওমরাহ পালনে হজের সওয়াব পাওয়া যায় : এ মাসে কোনো বান্দা যদি ওমরাহ পালন করে, তবে সে হজের সমান সওয়াব পাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে বললেন, রমজান মাস এলে তুমি ওমরাহ করবে। কারণ রমজানের ওমরাহতে হজের সমান সওয়াব দেয়া হয়। (সুনানে নাসায়ী)।
৬. সহনশীলতার মাস : রমজান মাস রোজাদারকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শক্তি জোগায়। এ মাসে সব ধরনের পানাহার ও সুন্দরী স্ত্রী কাছে থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে রোজাদার পানাহার ও সঙ্গম থেকে বিরত থাকে।
৭. মাহে রমজান ধৈর্যধারণের শক্তি জোগায় : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজান ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত।’ ধৈর্য কেবল পারিবারিক ক্ষেত্রেই নয়; বরং সামাজিক পরিমণ্ডলেও এক অনন্য মূল্যবোধের সৃষ্টি করে। ফলে সমাজে শান্তি ও ইনসাফের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ৮. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির মাস : মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। ধনী ব্যক্তি উপবাসের মাধ্যমে গরিবের দুঃখ ও অনাহারের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। একে অপরের সুখ-দুঃখ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
রোজাদারের জন্য পালনীয় বিষয়গুলোঃ রমজানের ফজিলত ও মর্যদা লাভের জন্য রোজাদারকে যেসব বিষয় পালন করতে হবে তা হলোঃ
১. রোজাদার অতিরিক্ত কথা বলবেন না।
২. অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ বর্জন করবেন।
৩. কারো সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবেন না। কেউ ঝগড়া করতে এলে (আমি রোজাদার) বলে তাকে বিদায় দেবেন।
৪. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকার করবেন।
৫. মিথ্যা কথা বলবেন না।
৬. কারো সমালোচনায় লিপ্ত হবে না।
৭. রোজার হক যথাযথভাবে আদায় করবেন।
৮. স্ত্রীর সাথে যৌনালাপ থেকে বিরত থাকবেন।
৯. অশ্লীল ও অশালীন ছবি-চিত্র দেখা থেকে বিরত থাকবেন।
১০. মুখ দিয়ে কোনো কিছুর স্বাদ গ্রহণ করবেন না।
১১. গরম বা রোদের কারণে বারবার কুলি করা যাবে না।
১২. অধিক উষ্ণতার কারণে গায়ে ভেজা কাপড় জড়িয়ে রাখা যাবে না।
১৩. বেশি বেশি দান-সাদকাহ করতে হবে।
১৪. রোজাদারের জন্য শরিয়ত নির্দেশিত সব অবৈধ কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।
১৫. যথাসময়ে সাহরি ও ইফতার গ্রহণ করতে হবে প্রভৃতি।
রোজা যেসব কারণে ভেঙে যায়ঃ রোজাদারকে জানতে হবে কী কারণে তার অতি কষ্টের রোজা ভেঙে যায়। রোজা ভেঙে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হচ্ছেঃ
১. ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু পানাহার করা।
২. স্ত্রী-সহবাস করা।
৩. স্ত্রী চুম্বন দ্বারা বীর্যপাত হওয়া।
৪. ইচ্ছা করে মুখভর্তি বমি করা।
৫. পাথর, লোহার টুকরা বা ফলের আঁটি প্রভৃতি গিলে ফেলা।
৬. ইচ্ছাকৃতভাবে গুহ্যদ্বার বা যৌনপথ দিয়ে যৌন সম্ভোগ করা।
৭. ইচ্ছাপূর্বক এমন জিনিস পানাহার করা, যা খাদ্য বা ওষুধরূপে ব্যবহার হয়।
৮. ডুজ নেয়া।
৯. কান বা নাকের ভেতর ওষুধ দেয়া।
১০. ধূমপান, লোবান এবং হুক্কা ইত্যাদির ধোঁয়া শুঁকলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়।
পরিশেষেঃ রোজার সার্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ বিভিন্ন পাপাচার থেকে দূরে থেকে সৎ কাজের প্রতি ধাবিত হয়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত, রোজার এ মহান শিক্ষাকে উপলব্ধি করা। তাই রোজার প্রতি সবারই যত্নবান হওয়া অপরিহার্য।