গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট স্বাস্থ্য অধিদফতর গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি আরও অভিযোগ করেন, অধিদফতরের কর্মকর্তাদের আচরণে ‘ঘুষ’ লেনদেনের ইঙ্গিত লক্ষ করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর স্বার্থে কাজ করছে।
সংবাদ সম্মেলনে আনা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেরেই বিজ্ঞানী এবং করোনাভাইরাস শনাক্তের পদ্ধতির উদ্ভাবক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীল। তিনি বলছেন, সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহর পাশে থাকলেও তার বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত নন।
রোববার (২৬ এপ্রিল) রাতে সঙ্গে কথা হয় ড. বিজন কুমার শীলের। এদিন বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ তুলে ধরেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি বলেন, তারা (স্বাস্থ্য অধিদফতর) আমাদের কনট্যাক্ট আফটার রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) করিয়ে আনতে বলেছে। কিন্তু কোথা থেকে সিআরও করিয়ে আনব, সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ডা. জাফরুল্লাহর অভিযোগ, কিছু ব্যবসায়ীর স্বার্থে কাজ করার কারণে অধিদফতর তাদের কিট গ্রহণ করছে না।
ডা. জাফরুল্লাহর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ড. বিজন কুমার শীল অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলাকে বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তো স্যাম্পল নেয় না। তারা বলে দেবে সেই স্যাম্পল কোথায় দিতে হবে। সে বিষয়েও এরই মধ্যে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। আশা করছি আগামীকালের মধ্যে আরও বিস্তৃত কিছু পাব। আমাদের ধারণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এটা করা হতে পারে। এছাড়াও আরও দুইটি স্থানেও হতে পারে।
ড. বিজন বলেন, টেস্টের জন্য যে লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে, তা আমরা দিয়ে দেবো। বিএসএমএমইউতে (বা যে প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা চলবে) যিনি প্রজেক্ট ইনচার্জ (পিআই) হবেন, তিনি একটি বাজেট জানাবেন। সেটা গণস্বাস্থ্যই দেবে। গবেষণায় তো পয়সাপাতি লাগেই। লজিস্টিক সাপোর্টসহ সেটা আমরাই দেবো।
ডা. জাফরুল্লাহ ‘ঘুষ’ নিয়ে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ড. বিজন বলেন, ‘না না, অনেক সময় হয়তো বলে ফেলেন। এখানে তেমন কিছুই লাগবে না।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বিরুদ্ধে নিজে কিছুই বলেননি দাবি করে ড. বিজন বলেন, ‘আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। প্রেস কনফারেন্সে আমি ছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি। বিষয়গুলো আমার জানা আছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমি অনেক প্রজেক্ট ডিল করেছি। তবে পরিস্থিতি যেহেতু এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে, তাই এগুলো নিয়ে বেশি কথাবার্তা না বলাই ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কিন্তু সবাই সাহায্য করছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা পাচ্ছি। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। তারা অনুমতি দিয়েছেন বলেই রিএজেন্ট আনতে পেরেছি। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তবে বিষয়টি একটু ত্বরান্বিত করলে ভালো হয়।’
এসময় প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে সময়ের দাবি অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের প্রতি আহ্বান জানান ড. বিজন কুমার শীল। তিনি বলেন, ‘আশা করি উনি আমাদের ভুল বুঝবেন না।’
সিআরও বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই বিজ্ঞানী বলেন, বিএসএমএমইউ বাংলাদেশের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান। এটি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সেখানে যোগ্য ব্যক্তি আছেন, ল্যাবরেটরি আছে। সেখানে সিআরও হলে আমার ধারণা কারো কোনো দ্বিমত থাকবে না। অনেক সময় দেখা যায়, যেখানে ট্রায়াল দিতে গেলাম সেখানে কিছু নেই। দেশের নামকরা কোনো প্রতিষ্ঠান, যেখানে ল্যাবরেটরি ও অভিজ্ঞ জনবলসহ সব সুবিধা আছে, এরকম কোনো প্রতিষ্ঠানে সিআরও হলে সেটা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। তারা যদি এই সিআরও’র জন্য দায়িত্ব নেয়, কাজটা ত্বরান্বিত হতে পারে। যেহেতু এটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তাই এক্ষেত্রে আসলে সবার সহযোগিতাটাই প্রয়োজন। কখনো কারও সঙ্গে কথাবার্তায় মনোমালিন্য হতে পারে। সেটাকে ভিন্নভাবে না নেওয়াই ভালো। ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক যেমন দেশের জন্য কাজ করছেন, ঠিক একইভাবে আমরাও কাজ করছি। তাই সবাই সবাইকে সাহায্য করে দেশকে সামনে নিয়ে যাব— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে গণস্বাস্থ্যের অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় অন্য তিন জনকে বসিয়ে রাখার বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ যে অভিযোগ এনেছেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষক ড. ফিরোজ বলেন, ‘আমরা যখন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) রুমে যাই, সেখানে আইসিডিডিআরবি’র ড. ফেরদৌসী কাদরী ও ড. ওয়াসিফ ছিলেন। আইসিডিডিআরবিতে তারা আমাদের সহকর্মী ছিলেন।’ সিআরও’র জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের খরচ অনুমতির অপেক্ষায় থাকা প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হয়, অর্থাৎ করোনা ডট ব্লোট কিট পরীক্ষার সিআরও’র টাকা-পয়সাও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে বহন করতে হবে বলে জানান ড. ফিরোজ।
ডা. জাফরুল্লাহ’র অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সেগুলোকে ‘মিথ্যাচার’ বলে অভিহিত করলেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘উনি চোখে মুখে শুধু মিথ্যা কথাই বলে গেছেন। কাজেই এ বিষয়ে আর কথাই বলতে চাই না। আজকে তাদের দু’জন এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। কিভাবে তাদের কাজ খুব ভালোভাবে হবে, সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।’
মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আলোচনা শেষে হাসিমুখেই তারা আমাদের এখান থেকে চলে গেছেন। তখন সাড়ে ৩টার মতো বাজে। এরপর ৪টার সময় সংবাদ সম্মেলন করেন ডা. জাফরুল্লাহ। সেখানে যা বললেন, সবই মিথ্যাচার। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা চাইছি সমাধানের দিকে যেতে। কিন্তু তিনি এটা চাইছেন না। উনি কথায় কথায় সংবাদ সম্মেলন করেন, আর সেখানে মিথ্যাচার করেন।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘যদি একটি ভালো কিট আসে, তবে তাতে তো দেশেরই ভালো। কিন্তু উনি আদৌ সেটা চাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আসলে আমি এখন সন্দিহান।’ সিআরও ছাড়াই কিট পরীক্ষাকে ডা. জাফরুল্লাহ কিভাবে সফল দাবি করছেন, সেটি নিজেই বুঝতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান।