১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্ম হয়। ঐ বছর জুলাই মাসে সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি অফিসার ও নাবিক পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করে দেশে এসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করেন। ভারত থেকে প্রাপ্ত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামের ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সকল নাবিক শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাশাপাশি ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে নির্ভীক ডুবুরীদল সমুদ্র ও নদী বন্দর সমূহে বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনা করে। এতে হানাদার বাহিনীর ২৬ টি জাহাজ ধ্বংস হয় ও সমুদ্রপথ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের সফল আক্রমণ মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সুচনা করে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বর্তমানে প্রায় ১২০০ অফিসার, ১২,০০০ নাবিক এবং ২৫০০ বেসামরিক কর্মকর্তা/কর্মচারী চাকুরীরত আছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ৮০ টি যুদ্ধ জাহাজ সহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, খুলনা ও মংলায় ৫টি বৃহৎ নৌঘাঁটি রয়েছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা রক্ষার মতো জাতীয় দায়িত্বে নিয়োজিত। দেশের তিন-চর্তুর্থাংশের সমান আয়তনের সমুদ্রসীমা রক্ষা এবং সমুদ্রসীমায় খনিজ সম্পদ ও মৎস্য আহরণসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দায়িত্ব। মুলতঃ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দায়িত্ব দুটি ভাগে বিভক্ত, যুদ্ধকালীন দায়িত্ব ও শান্তিকালীন দায়িত্ব। যুদ্ধের সময় সমুদ্র এলাকায় শত্রু মোকাবেলার পাশাপাশি গ্যাস, তেল ও খনিজ সম্পদের মত সমুদ্রসম্পদ রক্ষা এবং সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সচল রাখা নৌবাহিনীর গুরুদায়িত্ব। এছাড়া শান্তির সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা লোকচক্ষুর অন্তরালে সাগরে চোরাচালান বিরোধী অভিযান, জলদস্যু বিরোধী অভিযান, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মৎস্যসম্পদ রক্ষাসহ পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রন অভিযানে ব্যস্ত থাকেন। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা এবং দ্বীপাঞ্চলের মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
স্বাধীনতার পর নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য নৌবাহিনীর দুটি ফ্রিগেট বানৌজা ওমর ফারুক ও বানৌজা আলী হায়দার যথাক্রমে ১৯৭৬ এবং ১৯৭৮ সালে নৌবাহিনীতে সংযোজন করা হয়। ১৯৮২ সালে রাজকীয় নৌবাহিনীর তৃতীয় ফ্রিগেটটি বানৌজা আবুবকর নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তী দুই দশকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। নৌবাহিনীর আকার বৃদ্ধির পাশাপাশি এর কার্যপরিধি, দায়িত্ব ও ভবিষ্যত পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন সাধিত হয়। বিভিন্ন ধরনের জাহাজ সংযোজনের সাথে সাথে নৌবাহিনীতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র যেমন মিসাইল, টর্পেডো, মাইন এবং অন্যান্য সমরাস্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে নৌবাহিনীতে মিসাইল, টর্পেডো, মাইন এবং গোলাবারুদ সংরক্ষণ ও মেরামতের সক্ষমতা অর্জন করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের উন্নত নৌবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন, বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম ও জাহাজ সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। বর্তমানে নৌবাহিনী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা প্রতিরক্ষায় সদা প্রস্তুত। নৌবিমান শাখা সংযোজনের বিষয়টিও বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ আন্তজার্তিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা উন্নয়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সর্বপ্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদান করে। আমাদের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সমস্যাসংকুল এলাকায় জীবনের ঝুকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তারা তাদের বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করেছে। বর্তমানে ২১৯ জন নৌসদস্য আফগানিস্তান, বুরুন্ডি, কঙ্গো, চাঁদ, আইভরী কোষ্ট, লাইবেরিয়া ও সুদানে কর্তব্যরত আছে। অদ্যাবধি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১১২৪ জন সদস্য ২৩ টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছে।
অফিসার ও নাবিকদের প্রশিক্ষণের জন্য নৌবাহিনীতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ঘাঁটি রয়েছে। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমীতে অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া বানৌজা ঈসাখান, তিতুমীর ও শহীদ মোয়াজ্জেমে অফিসার ও নাবিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ দান করা হয়। মুলত নৌ-প্রশিক্ষণের যুগান্তকারী উন্নয়ন নৌ-সদস্যদের বিশ্বের যেকোন স্থানে দায়িত্ব পালনে সক্ষম আন্তর্জাতিক মানের অফিসার ও নাবিক হিসেবে তৈরি করছে। জাহাজের প্রশিক্ষণের জন্য অপারেশনাল সী ট্রেনিং গাইড গঠন করা হয়েছে এবং নৌযুদ্ধের কৌশল রপ্তকরণ ও জাহাজ পরিচালনা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে আধুনিক সিমুলেটর স্থাপন করা হয়েছে। স্কুল অফ মেরিটাইম ওয়ারফেয়ার অ্যান্ড ট্যাকটিকস-এ রয়েছে অত্যাধুনিক একশন স্পীড ট্যাকটিক্যাল ট্রেইনার, মেরীন ব্রীজ সিম্যুলেটর, সোলার মিস্যুলেটর এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিম্যুলেটর।
বাংলাদেশ নেভাল একাডেমীতে অফিসারদের চার পর্বে মোট দুই বছর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এর মধ্যে ক্যাডেট হিসেবে তারা ৬ সপ্তাহ এবং মিডশীপম্যান হিসেবে ছয় মাস জাহাজে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ লাভ করে। প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত নবীন অফিসারদের বিএসসি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। কমিশনের পর এক্সিকিউটিভ শাখার অফিসারগণ বানৌজা ঈসা খানে, সরবরাহ শাখার অফিসারগণ বানৌজা তিতুমীরে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল শাখার অফিসারগণ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজী-তে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করে। পেশাগত তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে অফিসারগণ জাহাজ থেকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ লাভ করে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে অফিসারগণ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাব-স্পেশাইলাইজেশন করে। সকল শাখার অফিসারগণ বাংলাদেশ নেভাল একাডেমীতে জুনিয়র স্টাফ কোর্সে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বানৌজা ঈসা খানে এক্সিকিউটিভ শাখার, বানৌজা শহীদ মোয়াজ্জমে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল শাখার এবং বানৌজা তিতুমীরে সরবরাহ শাখার অফিসারদের বিভিন্ন মেয়াদের স্পেশালাইজেশন কোর্স পরিচালনা করা হয়। সরবরাহ কোর্সের আওতায় উক্ত শাখার অফিসারগণ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। সীমিত সংখ্যক অফিসারকে সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজে স্টাফকোর্স ও আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স এবং জ্যেষ্ঠ অফিসারগণকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে উচ্চতর কোর্স করানো হয়। সকল শাখার নাবিকদের বানৌজা তিতুমীরে ছয় মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তারা নৌবাহিনীর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সীমিত সংখ্যক যোগ্য নাবিককে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও প্রেরণ করা হয়।
নৌবাহিনীর অফিসারদের র্যাংকসমূহ হচ্ছে অ্যাকটিং সাব-লেফটেন্যান্ট, সাব-লেফটেন্যান্ট, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার, কমান্ডার, ক্যাপ্টেন, কমোডর, রিয়ার অ্যাডমিরাল, ভাইস অ্যাডমিরাল ও অ্যাডমিরাল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনী ব্যাপক সামরিক ক্রয়-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর জন্য অস্ত্র, যন্ত্রপাতি এবং সামরিক সরঞ্জাম যেমন জাহাজ ধ্বংসকারী মিসাইল, সমুদ্রে টহলের বিমান, ফ্রিগেট, সাবমেরিন ও হেলিকপ্টার। নৌবাহিনীর সর্বাধুনিক ফ্রিগেট বানৌজা বঙ্গবন্ধুর ন্যায় অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ক্রয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি আগামী কয়েক বৎসরের মধ্যে নৌবাহিনীর পুরাতন জাহাজসমূহ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে যাত্রা শুরু করে ক্রমান্বয়ে নৌবাহিনীর জনবল বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত হয়েছে প্রশিক্ষণের মানও। নৌবাহিনীতে বর্তমানে অন্যান্য বাহিনীর প্রশিক্ষণার্থী ছাড়াও বন্ধুপ্রতীম বিদেশী নৌবাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া নৌবাহিনীর জাহাজ বিদেশে নিয়মিত শুভেচ্ছা সফরে গমন করে। এতে নবীন অফিসার ও নাবিকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের নৌ-সদস্যদের সাথে বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার সীমিত সংখ্যক যুদ্ধজাহাজ ও জনবল নিয়ে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বিশাল সমুদ্র এলাকায় স্বীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছে। নৌবাহিনীর প্রতিটি সদস্য ‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’ এ মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দেশমাতৃকার সেবায় নিবেদিত।