২০১৩ সালের এই দিনে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের একটি গণসমাবেশ এবং আন্দোলন সংঘটিত হয় এবং সরকার কর্তৃক পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বিত বাহিনী দ্বারা অপারেশন সিকিউর শাপলা অভিজান চালিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়।
রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবীতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর কথিত নাস্তিকদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ জেগে ওঠে কওমি মাদরাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় আসে সংগঠনটি।
৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পুরো ঢাকা অচল করে দেয় হেফাজতে ইসলাম। রাজধানীর মতিঝিল ও এর আশাপাশ এলাকায় চলে ধ্বংসলীলা। তবে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের কৌশলী ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসী অভিযানে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয় হেফাজতের নেতাকর্মীরা।
দেশ কাঁপিয়ে উত্থান ও ৫ মে ঢাকা অবরোধে দিনব্যাপী সহিংসতা, শাপলা চত্বরে অবস্থান, গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া হেফাজতে ইসলাম থিতিয়ে পড়েছিল। তবে সেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেই সরকারের হয়েছে আপোস রফা। বেশ কটি দাবি সরকার মেনে নেয়ায় হেফাজতে ইসলামও আন্দোলন থেকে সরে এসেছে বলে দাবি সংগঠনের নেতাদের। তবে সেই দিনের তাণ্ডব ভুলে যায়নি রাজধানীসহ দেশবাসী।
২০১৩ সালের ৫ মে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষে পাল্টা অবস্থান তৈরিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে হেফাজতে ইসলাম। এ কর্মসূচির ডেকে প্রথমবারেরমত আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম।
১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি চায় হেফাজতে ইসলাম। দুপুর ৩টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত সেখানে সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। তবে ৫ মে ভোররাত থেকেই রাজধানীর প্রবেশ পথে অবস্থান নেয় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এতে সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে মোড় নেয়। নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সারাদেশ থেকে মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক মতিঝিল ও এর আশপাশের প্রবেশপথগুলো অবরোধ করে। একপর্যায়ে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন।
শাপলা চত্বর থেকে রাতের প্রথম প্রহরে হেফাজতের কর্মীদের সরিয়ে দিতে অভিযান শুরু করে র্যা ব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। অভিযানের নাম হয় ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’। তিন বাহিনীর সদস্যরা শাপলা চত্বরের দিকে এগোতে শুরু করেন রাত ১টার দিকে। প্রথমে পুরো শাপলা চত্বরটি ঘিরে ফেলা হয়। পরে সেখানে জড়ো হওয়া হেফাজত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সরে যেতে বলা হয়। এর পরে ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল ছুঁড়তে শুরু করে পুলিশ। সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। এর পরই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে হেফাজত কর্মী সমর্থকরা। তাদের অনেকেই মতিঝিলের বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেন। ভোরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই সব ভবন থেকে শত শত হেফাজত কর্মীকে নামিয়ে আনেন এবং এলাকা ছেড়ে চলে যেতে সহায়তা করেন।
ভোরবেলা অনেক হেফাজত-কর্মী মাথার উপর দু-হাত তুলে লাইন ধরে পুলিশের কর্ডনের মধ্যে দিয়ে এলাকা ছেড়ে যায়। শাপলা চত্বরের ভ্রাম্যমাণ মঞ্চটি তখন পুলিশের দখলে। ভোর পর্যন্তও শাপলা চত্বরে কয়েক হাজার পুলিশ র্যা ব ও বিজিবি সদস্য অবস্থান করছিলেন এবং তারা মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলি করছিলেন। পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার মতোই। সারাদিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্ন ছিল আশপাশে ছড়িয়ে। পুলিশ ও গণমাধ্যমের গাড়ি ছাড়া আর কোন যান বা লোকজনের চলাচল ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাপলা চত্বর খালি করার সময় কাউকে গ্রেফতার করেনি।
ওই সময় অভিযানে অংশ নেয়া র্যা ব কর্মকর্তা লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, তাদেরকে গ্রেফতার করা যেতো, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে যার বাড়ি চলে যাক। সে কারণেই আমরা শক্ত অবস্থান নেইনি।
সেই অভিযানে বহু লোক হতাহত হওয়ার দাবি করে হেফাজত। পরদিন ৬ মে সকালেও নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহতের খবর জানা যায়।
হেফাজতের আমির ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে ৭ মে এক বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন, ওই অভিযানের সময় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক মারা গেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযানে কেউ মারা যায়নি বলে জানায়। এছাড়া নিহতদের তালিকা প্রকাশও করেনি হেফাজত। এছাড়া ওই ঘটনার ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচিতে হতাহতদের স্মরণে এ দিনটিতে আজ কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি হেফাজত।
এদিকে, শীর্ষ নেতৃত্বের কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে বৈষয়িক সুবিধা নেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে হেফাজতের অভ্যন্তরে ক্ষোভ-হতাশা ও সন্দেহ-অবিশ্বাস এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।
৫ মে`র ওই ঘটনায় ডিএমপির কয়েকটি থানায় ৪০টির বেশি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে ২১টির বাদী পুলিশ, বাকিগুলো আহত ও ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষ দায়ের করে। মামলাগুলোর বেশির ভাগই তদন্তাধীন। তবে মামলা ও সরকারি চাপে কোনঠাসা হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্যতা বাড়তে থাকে। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফীসহ কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। হেফাজত তথা কওমি শিক্ষার সঙ্গে জড়িতরাও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা এবং সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতেই অবিশ্বাস্য এই আঁতাতের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে। অনেকে বলছেন, বিএনপি জামায়াতকে জোটে নিয়ে সমালোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও হেফাজতকে কাছে টেনে একইভাবে সমালোচিত।
এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সংবাদ মাধ্যমে বলেন, কোরআন ও সুন্নাত রক্ষায় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছে হেফাজতে ইসলাম। সরকারের সঙ্গে কোনো আপোস হয়নি। তবে যা হয়েছে সেটাকে সমঝোতা বলা যেতে পারে।আমরা তাদের ছায়ায় যাইনি। কিছু বিষয়ে দূরত্ব কমেছে। ভবিষ্যতেও উত্থাপিত ১৩ দফা বাস্তবায়নে হেফাজত একইভাবে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পালন করবে।
এরপর ৩ বছরের মাথায় অনেক চড়াই-উৎরাই, আশংকা, অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী রাজনৈতিক সচেতন মহল, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ধারণার বাইরে থাকা হেফাজত বঙ্গবন্ধু কন্যা,দেশরত্ন শেখ হাসিনা কে কওমি জননী উপাধিতে ভূষিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রবিবার শোকরানা মাহফিলে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গওহরডাঙ্গার চেয়ারম্যান ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন এ উপাধি দেন।
মুফতি রুহুল আমীন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা আপনি স্বীকৃতি দিয়েছেন, সবকিছু উপেক্ষা করে। অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন, তার জবাব দিয়েছেন। ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর জননীর ভূমিকা আপনি (শেখ হাসিনা) পালন করেছেন। আজকে কওমি মহাসমুদ্রে আমি ঘোষণা করতে চাই, আপনি কওমি জননী। আজ থেকে আপনাকে এ উপাধি দিলাম। আপনার মাতৃত্বের ভূমিকা না থাকলে দেশবিরোধী, সাহাবাদের শত্রু, জামাত-মওদুদীবাদীরা এ দেশে (স্বীকৃতি) তা হতে দিতো না।’
আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ আয়োজিত এই শোকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত শোকরানা মাহফিলে সারাদেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেমরা উপস্থিত হন। সকাল ৯টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে মাহফিল শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতিত্ব করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা শাহ আহমদ শফী। প্রধানমন্ত্রী সকাল পৌনে ১১টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান। মঞ্চে আসন গ্রহণ করার আগে কওমি নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্রেস্ট দিয়ে সংবর্ধনা জানান শাহ আহমদ শফী। এছাড়াও শুকরিয়া আদায় করে দোয়া করেন শফী।
অনুষ্ঠান মঞ্চে কওমি আলেম ওলামাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান উপস্থিত ছিলেন।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।