পুরানো সম্পর্ক বটমূলের মতো হয়, প্রবল দুর্বিপাকেও তা মানুষকে আকঁড়ে ধরে রাখে, উপড়ে পড়তে দিতে চায় না।
আইনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর করতে ক শহর বদলালো, এমন কি আরো উচ্চশিক্ষার্থে লান্ডান যাবারও প্রস্তুতি শুরু করলো। তার শিক্ষাবর্ষের বেতন কয়েক লাখ টাকা আর প্রভাষক ছোট কাপড় পরা ইংরেজ ললনা।
আমাদের বন্ধুদের জন্য সেটা চরম দূর্যোগের এক মুহুর্ত; ছেড়ে চলে যাবার আগেই বন্ধুকে আটকাতে হবে, যে কোন মূল্যেই হোক। সে হিসাবে ক’কে জনৈকা “বালিকার” মূঠালাপনী সংখ্যা সরবরাহ করা হলো, “দোস্ত কথা বলে দ্যাখ”। মেয়ের নাম মাইশা, ব্রজলাল মহাবিদ্যালয়ে ইংরেজী প্রথমবর্ষের ছাত্রী। এভাবেই শুরু হলো ক’য়ের তিনশত বাহান্নতম “প্রথম প্রেম” কাহিনী!
মুঠালাপনীর প্রেম সেযুগে নূতন নূতন প্রসিদ্ধি লাভ করছে। যে সমস্ত মেয়েদের সাথে কথা বলা দূরে থাক, সাক্ষাৎ পাওয়াও আমাদের জন্য নিতান্ত দুরূহ ছিলো, মুঠালাপনীতে ব্যস কয়েকটা সংখ্যা মাত্র চেপে সহজেই তাদের মনের গহনে চলে যাওয়া যেতো।
একাবিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর সেই দিনগুলোতে যখন মাত্র হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে মুঠালাপনী দ্যাখা যেত, এর জাদুকরী ক্ষমতায় আমাদের পুরো প্রজন্ম মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলো।
ক’ও তার থেকে বাদ গ্যালো না, সকাল, দুপুর, রাত মাইশার সাথে সুখ সুখ গল্প করে পূর্ণেন্দুর কথোপকথনের ন্যায় তার মনের ঘরদোরেও তখন ধুলার ঝড়-“তারমানে সত্যি চলে যাবে? তারমানে… কখনো যাবোনা!”
ক একদম ঠিকঠাক বুঝে গিয়েছিলো যে আমাদের বন্ধুবান্ধবদের পিছু ছাড়াতে না পারলে ওর ভবিষ্যৎ নেহায়াতই তমশাচ্ছন্ন, তাই কারো সাথে আর যোগাযোগ রাখতো না, শহরে এলেও ঠিক ফেরৎ যাবার দিনটাতে মুঠালাপনীতে একবার ডাক দিতো শুধু “চলে গেলাম” বলার জন্য।
কিন্তু এবারে তিনি এলেন শুধু তাই না, আসবার আগেই বার্তা পাঠালেন যে- এই দফা আসিয়া মাইশা নাম্নী এক জাদুকরী রমনীর সহিত অবশ্যই সাক্ষাৎ করিতে হইবেক্। আর আমাদের মনে তখন- “এইবার ঘুঘু তোমার…..।”
যা হোক খুলনা নববিপণীর প্রধাণ ফটকে সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক হলো। ক’র বাবা সাবের সাহেব কোটিপতি হলে কি হবে পিতা হিসেবে অত্যান্ত কঠোর ছিলেন, দু’ঈদে কাপড় হিসেবে বিদ্যাপীঠের উর্দি উপহার দেবার মতো বাবা! কিন্তু ক দেখলাম এই প্রথমবার বেশ ভালো জামাকাপড় পরে এসেছে। খুলনার অলিগলিতে উষ্কখুষ্ক চুল আর ছেঁড়াফাটা জিন্স পরে ব্যাড়ানো ছেলেটা দেখছি রীতিমতো দাড়ি কামিয়ে একদম নিপাট ভদ্রলোক সেজে এসেছেন এবং এখনই বেশ চকচকে আইনজ্ঞ ভংগীতে চারপাশটা দেখছেন।
ক আর আমার খরচের হিসাবটা বেশ সাম্যবাদী, টাকা কার এটা ব্যাপার না, খরচ একজন করলেই হলো, ক তার পেটমোটা টাকার থলিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমিও গুরুত্বের সাথে তা নিজ ট্যাঁকে চালান করে দিলাম। আগামী কয়েক ঘন্টায় নায়ক/নায়িকা যত্রতত্র ঘুরবেন, খাবেন, যা খুশি তাই করবেন, আর পিছে থেকে নিঃশব্দে তার খরচটা চুকিয়ে দিতে হবে আমায়। ব্যাপার না, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে কথা।
৫টার সময় মাইশার আসার কথা, সাড়ে তিনটে থেকেই আমরা দুজন তেকোনা আইসক্রিম হাতে নববিপণীর ভেতরে গোলগোল ঘুরতে থাকলাম। নভেম্বরে কেউ বরফকাঠি খায়না কিন্তু আমরাতো আমরাই, দুনিয়াকে কিসের পরোয়া?
সমস্যা একটাই মাইশা দেখতে ক্যামন আমাদের দুজনের কারোরই তা জানা নেই। ক’র সাথে তাঁর নিয়মিত কথা হয়, আমার সাথেও দুএকবার বার্তা বিনিময় হয়েছে, কিন্তু সেযুগে চলছবি আলাপের (video call) সুযোগ না থাকায় Nokia 6630তে তাঁর গলার স্বর শুনলেও চেহারাটা অচেনাই ছিলো।
যাহোক প্রেম অন্ধ কিন্তু অন্ধকারেও দেখতে পায়, ও এলে ঠিকই চিনতে পারবো, এই সিদ্ধান্তে ৫টা বাজার কিছুক্ষণ আগেই আমরা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালাম, যাতে সে দ্যাখার আগেই আমরা দূর থেকে তাঁকে দেখে নিতে পারি।
“চেহারা ভালো না হলে এখান থেকেই রিক্সা করে ভেগে যাবি” আমি ক’কে বল্লাম। সে মনে হলো আমার কথা শুনে রীতিমতো আহত হয়েছে, কঙ্কাবতী হোক বা কৈকেয়ী কেকয়রাজ, আজ মনে হচ্ছে মিলন হয়েই ছাড়বে!
৫টা না বাজতেই আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলাম, আজই জানলাম খুলনার সব জুটিই প্রথম সাক্ষাতের জন্য নববিপণীর সামনে অপেক্ষা করে। নানা রঙের চলতি ধাঁচের পোশাক পরা মেয়েরা দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে তাদের মানস রাজপুত্রের অপেক্ষা করছে, এরমধ্যে মাইশা কোনটা উপরাল্লাই জানেন! সোয়া ৫টা বাজতেই আমি অধৈর্য্য হয়ে উঠে ক’কে বললাম- তাঁকে মুঠালাপনীতে একটা ডাক দে।
ক কিছুটা ইতস্তত করে বললো “তা করতে গ্যালে ও আগেই আমাদের চিনে ফেলবে, একটু ধৈর্য্য ধর”।
ধৈর্য্য? হায়! শুধু ও জিনিসটা থাকলে আজ আমি ক’র মতো আইনজ্ঞ না হোক কিছুনা কিছু একটা তো অবশ্যই হতাম!
ঠিক ৫টা চল্লিশে ক’র মুঠোফোন কু দিয়ে উঠলো, মাইশার ডাক!
ক জলদি ওঠালো “কই তুমি?”
-“আমি এইতো রিক্সায় বসে আছি, তোমাকে দেখছি নাতো!”
“আচ্ছা তুমি কি ঐ সাদা কামিয আর লাল ওড়না পরা মেয়েটা?”
-“তারমানে তুমি এখানেই? কই দেখছিনাতো?”
“তুমি ৫টা মিনিট অপেক্ষা করো আমি একটা জরুরী কাজ সেরে পৌছাচ্ছি।”
-“মানে কি!”
ক কোন জবাব না দিয়ে ঝট করে কেটে দিলো, “ঐ খালি!” রিক্সা দাঁড়াতেই চট করে উঠে বসে আমাকে ডাক দিলো “জলদি আয়!”
-কিরে সমস্যা কি?
“আয় বলছিনা? জলদি!”
-কি হয়েছে বলবিতো?
“মেয়েটাকে দেখেছিস? অতো সুন্দর মেয়ের সামনে যেতে পারবোনা, দূর থেকে আলাপই ঠিক আছে।”
-এ্যঁ! এটা আবার ক্যামন কথা?
“তুই কি মেয়েটাকে দেখেছিস?”
-কোনটা?
“ঔযে রজনীগন্ধা আর গ্লাডর্যক্স বিক্রি করছে চাচাটা, তারপাশে যে সাদা সালওয়ার-কামিয পরা মেয়েটা ওটাই।”
আমি ঘুরে তাকালাম, ১০/১২টা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরো বহুলোক চলাফেরা করছে, কিন্তু আর সবার মধ্যে থেকেও তাঁকে একদম আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ঘন চুল, বেগম খালেদা জিয়ার মতো গায়ের রঙ, উচ্চতাও ওরকমই হবে, শুধু বয়স ২০/২১ গোছের, চোখের ওপর একটা ইয়াব্বড় কালো রোদচশমায় গোলগাল মুখটার অর্ধেকই ঢেকে গ্যাছে আর ফর্সা আহ্লাদী গালে অপেক্ষার বৈরক্ত্য। “বরফজাদী!” আমি মনে মনে ভাবলাম।
“তুই আসবি? না আমি চলে যাবো?” ক আমাদের ছেড়ে অনেক আগেই চলে গ্যাছে, এখানে ফেলে যাওয়া খুব বড় কোন বিষয় হবেনা।
-“এটা করা যাবে না”, আমি খুব শান্ত ভাবে ওকে জানালাম।
“ক্যানো?”
-তুই একটা মেয়েকে পছন্দ না করলে সেটা তাকে সরাসরি বল, এভাবে দ্যাখা না করে চলে যাবি, এমন অসম্মান হওয়ার মতো ওকি কিছু করেছে?
পছন্দ করিনা তাতো বলছি না, শুধু দ্যাখা করতে চাচ্ছি না।
-আরে ব্যাটাছেলে হয়ে ভয় পাস কিসের?
“ভয় না দোস্ত, আমার ক্যামন জানি লাগছে, এতো সুন্দর কোন মেয়ের সাথে কখনো কথা বলিনিতো, আচ্ছা কাল আবার আসবোক্ষণ।”
-কাল? তোর যদি আজকে সাহস না হয়, তা হলে আর জীবনেও হবেনা। তাছাড়া দ্বিতীয়বার ও আসবে ভাবছিস?
“না আসলে নাই, আমি পরোয়া করিনা, চল!”
-তুই পরোয়া না করলে না করলি কিন্তু আজ এভাবে কোন কথা না বলে চলে গ্যালে ও বেচারির কতোটা খারাপ লাগবে, একবার ভেবে দেখেছিস? মেয়েটারকি এই অপমান প্রাপ্য?
“দোস্ত আমি ওর সামনে যেতে পারবো না।”
-কিচ্ছু সমস্যা নেই, দ্যাখা করে অন্তত একবার সামনাসামনি পরিচিত হ, তারপর না হয় খুব জরুরী কাজ আছে বলে ভেগে আসিস, ব্যাপার না।
“তাহলে তুই যা”
-আমি গ্যালেই বা কি? আমি তোর বন্ধু ঠিকাছে কিন্তু ওকি আমার সাথে দ্যাখা করার জন্য এসেছে?
“না তানা, দ্যাখ ওতো আর আমাকে চেনেনা, তুই গিয়ে বল যে তুইই ক, মানে আমি সেজে দ্যাখা কর।” ক’র পাল্লায় পড়ে আমি মানব সমাজে অগ্রহণযোগ্য এমন অনেক কাজই করেছি কিন্তু এবারেরটা মাত্রাছাড়া।
-“এরমানে কি? আমি গিয়ে কি বলবো ওকে?” মুখে বললাম বটে, কিন্তু মনে দারুণ এক শিহরণ কাজ করে গ্যালো, অদ্ভুত আর সীমার বাইরে গিয়ে কিছু করার আমার বরাবরই খুব আগ্রহ।
“আমাকে এতোক্ষণ ধরে যা কিছু বোঝাচ্ছিলি, ওগুলোই গিয়ে বল ওকে, এক দুইদিন পার হলে যখন খানিকটা সহজ হয়ে যাবে, তখন ওকে বুঝিয়ে বলবি যে আসল “ক” আমি।”
-ক যখন কথা বলে মনে হয় বন্ধু না, পরিচালক মণ্ডলীর প্রধান না বুঝেই কোন বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছে। “ঠিক আছে” আমি সহজেই রাজি হয়ে গেলাম, দুজনে চটজলদি মুঠালাপনী বদল করে নিলাম, কাজ হোক বা অকাজ, তত্ব/প্রক্রিয়ায় কোন ভুল থাকা চলবে না। রওনা দেবার ঠিক আগে ক’র দিকে টাকার থলিটা এগিয়ে দিলাম, ভূমিকা বদলে গ্যাছে, দ্বায়িত্বও!
যথারীতি ক’কে বগলদাবা করে আমি নিজের দুই গজ উচ্চতা আর সবচেয়ে উজ্জ্বল হাসিটা নিয়ে মাইশার সামনে উপস্থিত হলাম, দেখে মনে হলো না যে সে খুব বেশী আপ্লূত হলো। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ হতেই সে বড় বড় চোখ করে বললো “তুমি উকিল? দেখে একদম লাগেনা কিন্তু!”
-উকিল না আইন ছাত্র, আর পড়ালেখা শেষ করার পরও ব্যারিস্টার হবো, উকিল না। হুবুহু ক’য়ের সংলাপ বলে খোদ ক কেই তাক লাগিয়ে দিলাম।
“হাহ, পার্থক্য কি?”
-৭টা খুন করে ফ্যালো তোমার কিচ্ছু হবে না কিন্তু যদি আমার হৃদয় ভাঙো, হাড়েহাড়ে টের পাবে যে ব্যারিস্টার কাকে বলে!
মাইশা হাহা করে হেসে ফেললো, দূর্গ পতনের প্রথম লক্ষণ। ক এতোক্ষণ বেশ মজা পেয়েই মিটিমিটি হাসছিলো, এবার দেখলাম খানিকটা গম্ভীর হলো। শুধুমাত্র অভিনয় করার কথা ছিলো কিন্তু আমার কি দোষ? মনে মনে ভাবলাম, আমি যে কোন দ্বায়িত্বই খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে ফেলি।
-“তোমাকে দেখেও ঠিক ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মনে হয় না” পাল্টা আক্রমণ।
“পরিচয়পত্র দ্যাখাবো?”
-নানা, আজকাল ওসবও নকল করা যায়, একটা ধাঁধা জিগ্যেস করি, উত্তর দিতে পারলে বুঝবো আসলেই পড়ো।
“কি ধাঁধা, জিগ্যেস করো।”
- “By the pricking of my thumbs,
Something wicked this way comes.
Open, locks, Whoever knocks!” কার লেখা?
“তোমার নিজের।”
-না হয়নি, লেখক ইংরেজ, এটা ইংরেজী সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটা রচনা থেকে নেওয়া। তোমার জানার কথা।
উমম্ টেনিসন?
-না হয়নি।
“মিল্টন?”
-মিল্টন! তুমি কি আসলেই ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী?
“নাহ পারবো না, তুমিই বলো।”
-উইলিয়াম শেক্সপীয়ার।
“অসম্ভব!”
-ম্যকবেথ, চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য। সারাজীবনে শেক্সপীয়ারের একটাই বই পড়েছি কিন্তু খুব ভালোমতো পড়েছিলাম, আজ কাজে লেগে গ্যালো।
দৃশ্যতঃ কাজ হলো, মাইশা একটু গভীর চোখে তাকালো আগের মতো অতোটা হালকা ভাবছেনা আর। উপযুক্ত সময়, বেয়ারাকে ডেকে কফির ফরমাস জানালাম, ক টাকার থলে সহ তৈরী, বিল চুকানোর জন্য একজনকে তো লাগে।
ফেরার পথে দুজনেই চুপচাপ রিক্সায় বসে আছি, কথা দূরে থাক, যার যার মনোভাব একে অন্যের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছি। কর্কশ শব্দে ক’র নুঠালাপনী বেজে উঠলো, মাইশার ক্ষুদে বার্তা, ক’র চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়লো এই গল্পে আমার ভূমিকা শুধুই নায়কের পার্শ্বচর বা বিদূষকের। কপোত কপোতীর আসল প্রেমতো মুঠালাপনীতেই চলছে।
ক মুঠোফোনের সংখ্যা টিপে ডাক দিলো- হ্যালো মাইশা!