মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী রাসুলদের উপর প্রেরণ করেন মহান আসমানি কিতাব বা ঐশীগ্রন্থ। আর সর্বশেষ বিজ্ঞানময় এবং মানবতার মুক্তি স্বরুপ পবিত্র আল কুরআন মানব জাতিকে দান করেছেন মহান আল্লাহ তা’আলা। আল্লাহ তা’আলা তার মনোনীত ফেরেস্তা বা দূত জিব্রাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ বিশ বছরে ধারাবাহিকভাবে মানব জাতিকে অন্ধকারচ্ছন্নতা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তিদানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর যে পবিত্র আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন বা আল ফুরকান। তাই প্রকৃত ইসলামের পথে চলতে হলে আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ সক্ষমতা অনুযায়ী পবিত্র আল কুরআন পড়তে ও জানতে হবে। আমরা যদি নিজেকে প্রকৃত মুসলমান হিসাবে দাবী করতে চাই এবং আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দেখানো পথ এবং আদর্শকে অনুসরণ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই সর্ব প্রথম আমাদের কুরআন চর্চা এবং শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর পবিত্র আল কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱقۡرَأۡبِٱسۡمِرَبِّكَٱلَّذِيخَلَقَ١﴾العلق:
অর্থ: ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক- ১]।
পবিত্র আল কোরআন মানবতা এবং সহনশীলতা শিক্ষা দানের পাশাপাশি আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করে এবং সঠিক পথে নিজেকে পরিচালনায় ইতিবাচক দিক নির্দেশনা প্রদান করে। যাতে পবিত্র কুরআনের গভীর মর্মবাণী অনুধাবণ ও শিক্ষা অর্জন করে আমরা ইসলাম ও বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হই। পাশাপাশি ইহুদি এবং নাসারাদের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে প্রতিহত করার যথেষ্ঠ যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞনে উৎকর্ষতা এবং সাফল্য লাভে পবিত্র আল কুরআনের মর্মবাণী এবং গবেষণা এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন সময়ে ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বিশ্ব বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুড়ে শিল্প এবং প্রযুক্তি বিল্পব সংঘটিত হয়। যার চুড়ান্ত শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত সুফল আমরা আজ উপভোগ করছি। তাই আমাদের অবশ্যই কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। কুরআন শিক্ষার সর্বোচ্চ নির্দেশ দিয়ে ইবন মাসউদ (রাঃ) এর বর্ণনা মতে, মহানবী (সাঃ) বলেন,
«تَعَلَّمُواالْقُرْآنَ،وَاتْلُوهُ»
অর্থ:‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ:৮৫৭২]।
যদিও জ্ঞানের আলো নিভে মুসলিম বিশ্ব আজ দিশাহার এবং অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় প্রাচ্য এবং প্রাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে যুদ্ধ বিগ্রহে যতজন মানুষ মারা যায় তার ৯০% মানুষ মুসলিম বিশ্বের কোন না কোন দেশের নাগরিক। অথচ আধুনিক সভ্যতার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্যে থেকে যদি মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে এই বর্তমান যুগের আবিষ্কার এবং আধুনিকায়ন নিশ্চিতভাবেই ধসে পড়বে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন এবং ধারাবাহিক বিকাশে মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেছেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত মুসলিমরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি এবং সভ্যতার বাতিঘর ছিল’। সমকালীন সময়ে মুসলিম বিশ্বের ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা এবং গবেষণায় প্রবল প্রতিযোগিতা করত। সেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল জগৎ খ্যাত জাফর আল-সাদিক, জাবির ইবন হাইয়ান, ইবনে খালদুন, আল বিরুনী, আল কেমি, ইবনে সিনা, আল-খোয়ারিজম, ইবন তুলুন, ইবনে আল হাইছাম, ইবনে বতুতার মতো অসংখ্য খ্যাতিমান দার্শনিক, সাধক, বিজ্ঞানী, ভুগোল ও ভূতত্ত্ববিদ, গণিতবিদ , জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসক এবং চিন্তাবিদ। তাই কুরান মাজীদ যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম উৎস এবং পবিত্র কুরআন জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে নির্ভুল ও বাস্তব সম্মতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পবিত্র আল কুরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
﴿يسٓ١وَٱلۡقُرۡءَانِٱلۡحَكِيمِ٢﴾يس: ١،٢
অর্থ: ‘ইয়া-সীন। বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ’ [সূরা ইয়াছিন:১-২]।
আবার মহাবিশ্বের সাম্প্রসারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “আমি নিজ হাত দ্বারা আকাশ মণ্ডলী সৃষ্টি করেছি এবং আমিই এর সম্প্রসারণকারী।” (জারিয়াত, আয়াত-৪৭)। এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, বর্তমান সময়ে খ্যাতিমান পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস তার বিখ্যাত ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইমস’ (A Brief History of Times) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “মহাবিশ্ব সর্বদাই সম্প্রসারিত হচ্ছে।” সুতারাং এ থেকে প্রমাণ হয় বিজ্ঞান এবং কোরআন একে অপরের বিরুদ্ধে নয়, বরং একে অপরের নিয়ামক বা সহযোগী।
খ্যাতনামা ফরাসী বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদ ডক্টর মরিস বুকাইলি তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণামুলক ‘দি বাইবেল, দি কোরআন এ্যান্ড সায়েন্স’ গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের মাধম্যে প্রমাণ করেছেন যে, পবিত্র আল কোরআনই একমাত্র আসমানী কিতাব, যা সকল ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। শুধু তাই নয়, পবিত্র আল কোরআনে বিজ্ঞান সম্পর্কিত এমন সব বক্তব্য, বর্ণনা, আয়াত এবং ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা বর্তমান যুগের সর্বাধুনিক তথ্যজ্ঞান এবং আবিষ্কারের নিরিখে সঠিক ও সত্য বলে চুড়ান্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাছাড়া অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলিম জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য আল-কুরআন হলো এক আলো বা নুর। আর এই কুরআনের আলো হৃদয়ে ধারণ করে একতাবদ্ধভাবে স্বল্প পরিসরে হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে মুসলিম বিশ্বের কল্যান ও উন্নতি সাধণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাই পবিত্র কুরআন শিক্ষা নির্ভর বস্তব জীবন ভিত্তিক ইসলামী সমাজ গড়ে তোলা ব্যাতিত ইসলামের শত্রুদের কার্যকরভাবে প্রতিহত করার বিকল্প কোন রাস্তা খোলা আছে বলে মনে হয় না। পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
﴿قَدۡجَآءَكُممِّنَٱللَّهِنُورٞوَكِتَٰبٞمُّبِينٞ١٥يَهۡدِيبِهِٱللَّهُمَنِٱتَّبَعَرِضۡوَٰنَهُۥسُبُلَٱلسَّلَٰمِوَيُخۡرِجُهُممِّنَٱلظُّلُمَٰتِإِلَىٱلنُّورِبِإِذۡنِهِۦوَيَهۡدِيهِمۡإِلَىٰصِرَٰطٖمُّسۡتَقِيمٖ١٦﴾المائدة: ١٥،١٦