মনসুর আহমদঃ হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী (আ.) দুনিয়ায় এসছেন এবং তাঁদের উপর যত আসমানী কিতাব, সহীফা নাজিল হয়েছে এর সবগুলোতে রাসূল (সা.)-এর আগমন বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীতে ইসলাম বাদে যত ধর্মমত ও ধর্মগ্রন্থ আছে সেখানেও নবী (সা.)-এর উচ্চ প্রশংসাসহ তাঁর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে এসেছে, হজরত ঈসা (আ.) শেষ নবী সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্ববাণী করেছিলেন- “এবং স্মরণ কর যখন মরিয়ম পুত্র ঈসা বলেছিলেন, হে ইসরাইল বংশীয়গণ নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। আমার সামনে যে তাওরাত কিতাব আছে আমি তার সত্যতার প্রমাণকারী এবং এরূপ একজন প্রেরিত পুরুষের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যাঁর নাম হবে আহমদ” (সূরা সফ-৬)
হজরতের সাহাবাগণও বাইবেলে তাঁর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ করেছেন। আতা ইবনে ইয়াসর (রা.) নামক সাহাবী বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আসের সাথে সাক্ষাত করে বললাম, আপনি আমাকে রাসূল (সা.) সম্বন্ধে তাওরাতে লিখিত গুণাবলীর সংবাদ দিন। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ, কুরআনে উল্লিখিত কতক গুণাবলীর কথা তাওরাতে উল্লিখিত হয়েছে – ‘হে নবী! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা সাবধানকারী এবং নিরক্ষর সম্প্রদায়ের জন্য আশ্রয়স্থল করেছি। তুমি আমার সেবক রাসূল, তোমাকে নির্ভরকারী নাম দিয়েছি।’ তিনি কর্কশ ভাষী নন, কঠোর হৃদয়ের নন, বাজারে কলহকারী নন। ‘তিনি ক্ষতির প্রতিশোধে ক্ষতি করেন না’। বরং মার্জনা করেন এবং ক্ষমা করেন। যতক্ষণ তিনি কুটিল ধর্মাবলম্বীকে সরল না করেন, এমনকি তারা এক আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য নেই বলে এবং বাক্যের দ্বারা তিনি অন্ধ চক্ষুগুলোকে চক্ষুষ্মান না করেন। এবং বধির কর্ণগুলোকে শ্রবণকারী না করেন এবং আবৃত হৃদয়কে মুক্ত না করেন, সে পর্যন্ত আল্লাহ কিছুতেই তাঁকে মৃত্যুগ্রস্ত করবেন না। (মিশকাতুল মাসাবিহ, বোখারী, তিরমিযী)
হজরত কাব (রা.) তাওরাত থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আমরা তাওরাতে লিখিত পাচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, আমার সম্মানিত সেবক। তিনি কর্কশ ভাষী নন, কঠোর হৃদয় নন, বাজারে কলহকরী নন, মন্দের বদলে মন্দ করেন না, কিন্তু মার্জনা করেন ও ক্ষমা করেন। তাঁর জন্ম স্থান মক্কা তাঁর হিজরত স্থান ইয়াসরিব (মদীনা) এবং তার রাজ্য সিরিয়া দেশ।” (মিশকাত দারেমী থেকে)
নবী (সা.)-এর দুনিয়ায় আসার দুই আড়াই হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মের বেদ গ্রন্থে নবী করীম (সা.)-এর জন্ম থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি সঠিক ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী নিখুঁতভাবে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে।
“ভবিষ্যৎ অবতার কল্কি সম্বন্ধে মহাভারতে কথিত হইয়াছে কালক্রমে সম্ভল গ্রামে বিষ্ণুযশা ঃ নামক এক ব্রাহ্মণ উৎপন্ন হইবেন। মহাবীর মহানুভব কল্কি সেই ব্রাহ্মণ গৃহে জন্ম গ্রহণ করিবেন। তাঁহার মনন মাত্রেই সমুদায় বাহন, করচ, বিবিধ আয়ূধ ও ভুরি ভুরি যোদ্ধা উপস্থিত হইবেন। তিনি ধর্ম বিজয়ী ও সম্রাট হইয়া পর্যাকুল লোক সকলের প্রতি প্রসন্ন হইবেন। ক্ষয়কারী ও যুগ পরিবর্তক সেই দীপ্ত পুরুষ উত্থিত ও ব্রাহ্মনগণ পরিবৃত হইয়া সর্বত্র গত ম্লেচ্ছগণকে উৎসাহিত করিবেন।” বনপর্ব, মার্কয়ে সমস্যা পর্বাধ্যায়, ১৮৯ অধ্যায়। পুরাণে কল্কির মাতার নাম সুমতি । বিষ্ণুযশাঃ এবং সুমতি আবদুল্লাহ এবং আমিনার সংস্কৃত অনুবাদ। ধর্মদ্রোহী কাফিরগণকে ম্লেচ্ছ এবং মুসলমানকে ব্রাহ্মণ বলা হইয়াছে।” (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)
সনাতন ধর্মের মূলগ্রন্থ বেদ গীতা পুরান উপনিষদ ইত্যাদি গ্রন্থে শেষ অবতার বা শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সমবেদে যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম এভাবে বলা হয়েছে।
মদৌ বর্তিতা দেবাদ কারান্তে প্রকৃত্তিতা
বৃষাণং ভক্ষয়েৎ সদা সেদা শাস্ত্রের স্মৃতা
অর্থাৎ যে দেবের নামের প্রথম অক্ষর ম ও শেষ অক্ষর দ এবং বৃষমাংস ভক্ষণ সর্বকালের জন্য বৈধ করবেন। তিনিই হবেন বেদ অনুযায়ী সেই ঋষি। মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম অক্ষর ও শেষ অক্ষর বেদের নির্দেশ মতে ম ও দ তাকেই মান্য করে চলা শাস্ত্রের নির্দেশ।
কল্কি পুরাণ ২য় অধ্যায় ২৫ শ্লোকে বলা হয়েছে-
‘দ্বাদশ্যং শুক্লপক্ষস্য মাসি মাধবম।
জাতো দট্টশতুঃ পুত্রং পিতরৌ হৃষ্টমানসৌ।’
এখানে মাধব মাসের দ্বাদশী শুক্লপক্ষে জন্ম গ্রহণ অর্থ অন্তিম ঋষি মাধব মাসের (বৈশাখ) শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী তিথিতে জন্ম গ্রহণ করবেন। নিঃসন্দেহে ইহা মুহম্মদ (সা.)-এর জন্মগ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়েেেছ। হিসাব করলে দেখা যায়, ৫৭০ খৃ. ১২ রবিউল আউয়াল বৈশাখ মাস অর্থাৎ মাধবমাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথি।
অষ্টাদশ পুরানের মধ্যে ভবিষ্য পুরানে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এ ভাবেÑ
‘এতস্মিম্মন্তরে ম্লেচ্ছ আচার্যেন সমন্বিতঃ।
মুহামদ ইতিখ্যাত ঃ শিষ্যশাখা সমন্বিত ॥ ৫॥
নৃপশ্বৈব মহাদেবং মরুস্থল নিবাসিনম্
গঙ্গা জলৈশ্চ সং¯œাপ্য পঞ্চগব্য সমন্বিতৈঃ।
চন্দনাদিভিরভ্যর্চ্চ্যতুষ্টাব মনসা হরম ॥ ৬॥
অর্থাৎ- মহামদ নামে খ্যাত একজন ম্লেচ্ছ (বিদেশী) ধর্মগুরু শিষ্যগণসহ আবির্ভুত হইবেন । তিনি মরুভূমির (আরব মরুভূমি)নিবাসী মহাদেব নৃপতি (রাজর্ষি)। তিনি গঙ্গাজলে পঞ্চবৎগব্যসহ ¯œান করিয়া মনতুষ্টি করিবেন। (ইহা রূপকার্থে ব্যবহৃত। প্রকৃত অর্থ- পাঁচবারি পবিত্র পানি দ্বারা ওজু করে পাঁচবার নামাজ পাঠের দ্বারা মনতুষ্টি করিবেন।
অল্লোপনিষদের একটি স্থানে দেখা যায় :
হোতারমিন্দ্রো হোতারমিন্দ্রে মহাসুরিন্দ্রা ঃ
অল্লো জেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমংপূর্ণং ব্রহ্মাণ অল্লাম॥
অল্লোহ রাসূল মুহমদরঃকং বরস্য অল্লো অল্লাম।
আদল্লংবুকমে কং অল্লাবুকংনির্খাতকম॥ ৩॥
অর্থাৎ আমার অস্তিত্ব আছে। আমি মহা ইন্দ্রের ইন্দ্র। আমি জ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ পরমপূর্ণ ব্রহ্ম। আমি আল্লাহ । আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের তুল্য আর কে আছে? আমি আল্লাহ। আমি অক্ষয়, অবিনশ্বর এক এবং স্বয়ম্ভু।
অন্কথা ঃ অন্ সংস্কৃত শব্দ, ইহার অর্থ ‘না’। “অন্ কথার” দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেই উপাস্য নাই এই কথা বুঝায় । হিন্দু সমাজে এখনও প্রচলিত প্রথানুসারে মরণোন্মুখ ব্যক্তিকে ঘর থেকে বের করে মুক্ত আকাশের তলে বিশেষ করে তুলসী গাছের তলায় রাখা হয়। সে ব্যক্তির প্রাণ বায়ু বেরোতে অধিক বিলম্ব বা কষ্ট হলে তার কানে কানে “অন্ কথা” পাঠ করে শুনানো হয়। এই অন্ কথার অর্থ অধিকাংশ লোকই জানে না। বাদশাহ আকবরের দরবারে পণ্ডিতদের এক বাদানুবাদ সভায় এক তর্কের জবাবে এক নওমুসলিম ব্রাহ্মণ পণ্ডিত “অন্ কথার” প্রকৃত তাৎপর্য সর্ব সমক্ষে ফাঁস করে দিয়ে “উত্তারায়ন” বেদ হতে নি¤েœাক্ত শ্লোক পাঠ করেনঃ
“লা এলাহা হরতি পাপম্ ইল্লইলহা পরম পদম
জন্ম বৈকুণ্ঠপর অপ্ ইনুতি ত জপিনাম মুহম্মদম।”
বঙ্গানুআদঃ “লা ইলাহা” কহিলে পাপ মোচন হয়, ইল্লাল্লøøা কহিলে উচ্চ পদবী লাভ হয় । “যদি চিরতরে স্বর্গে বাস করিতে চাও, তবে মুহাম্মদ নাম জপ কর।”
(প্রফেসর মফিজ সরকার- মাসিক মদীনা, জুলাই -৯৮)
লেখার কলেবর বৃদ্ধি না করে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু সামান্য তুলে ধরে লেখার যবনিকা টেনে দেয়া শ্রেয়।
তাওরাতে রাসূল (সা.)-এর সু সংবাদ : তাওরাত হচ্ছে মুসা (আ.)-এর উপরে নাজিলকৃত আল্লাহর কিতাব। তাওরাতে আছে- “আল্লাহ বলেন, আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার (মুসার) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত এবং তার মুখে আমার বাণী প্রকাশ করব। তিনি তোমাদেরকে তাই শুনাবেন যা আমি আদেশ করব। ”(বিশ্বনবী)
অন্যত্র আছে ঃ “তোমাদের প্রভু আল্লাহ তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকে আমার (মুসার) মতই একজন পয়গম্বর সৃষ্টি করবেন, তাঁর কথা তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ” (বিশ্বনবী)
ইঞ্জিলে- “যখন এই ‘সত্য আত্মা’ আসবেন তখন তিনি তোমাদেরকে সর্বপ্রকার সত্যপথে চালিত করবেন; কারণ তিনি নিজের কথা কিছু বলবেন না। কিন্তু যা তিনি (আল্লাহর কাছ থেকে) শুনবেন তাই বলবেন এবং তিনি ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা দেখাবেন।” (বিশ্বনবী)
‘সত্য আত্মা’ দ্বারা যীশু বুঝাতে চান যে, সেই সহায় হবেন সকল নবীর সরদার সাইয়্যেদুল মুরসালীন।
শলোমনের পরমগীত : বাইবেলের শলোমনের পরমগীত পুস্তিকায় বিশ্বনবীর আবির্ভাব সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নাম উল্লেখ করে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। হজরত সোলায়মান (আ.) ভবিষ্যতের নবীর নাম উল্লেখ করেছেন ‘মহামাদইম’ নামে। হিব্রুভাষায় শব্দের শেষে ‘ইম’ প্রত্যয় সন্মানার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ এর প্রতিশব্দ ‘এলোহা’। বাইবেলে এ শব্দটি ‘এলোহিম’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, এটা পরিষ্কার যে সোলায়মান (আ.) খুব স্পষ্টভাবেই ভবিষ্যৎ নবীর নাম ‘মহামাদইম’ বলে উল্লেখ করেছেন।
বারনাবাসের বাইবেলে- বারনাবাস রাসূল (সা.)-এর আগমন সস্পর্কে হজরত ঈসার যে সব ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরেছেন সে সব বাণীতে হজরত ঈসা কোথাও নবী করীম (সা.)-এর নাম উল্লেখ করেছেন, কোথাও শুধু রাসূলুল্লাহ বলেছেন আবার কোথাও তাঁকে মসীহ নামে উল্লেখ করেছেন।
বারনাবাস বাইবেলে বলা হয়েছে, ঈসা তার শিষ্যবর্গসহ জর্ডান নদী অতিক্রম করে মরু অঞ্চলে গমন করলেন আর জোহরের নামাজ শেষ করার পর একটি গাছের নিকট উপবেশন করলেন এবং পাপ বৃক্ষের ছায়ায় জড়ো হলেন তাঁর শিষ্যবর্গ।
ঈসা তখন বললেন, “তকদির এত দুর্জ্ঞেয় হে ভাইসব! যা আমি তোমাদেরকে বলছি, অবশ্যই একজনের কাছে তা ধরা পড়বে। তিনি হলেন সেই জন যাকে জাতিপুঞ্জ সন্ধান করছে, যার কাছে আল্লাহর রহস্যাবলী এত স্পষ্ট যে যখন তিনি দুনিয়ায় আগমন করবেন, সৌভাগ্যবান হবেন তারা যারা তাঁর বাণী শ্রবণ করবেন। কারণ তাদের ওপর আল্লাহ পাক রহমতের ছায়া বিস্তার করবেন; ঠিক যেমনি এ পাপ গাছটি আমাদের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে ছায়া। হ্যাঁ, ঠিক এই গাছটি যেভাবে আমাদেরকে রক্ষা করেছে সূর্যের খরতাপ থেকে, তেমনি আল্লাহর করুণা বাঁচাবে শয়তান থেকে তাদেরকে যারা সেই মানুষের ওপর ঈমান আনবে।”
শিষ্যগণ বললেন, ওগো মুর্শিদ! সেই মানুষ কে হবেন যাঁর সম্পর্কে বলেছেন আপনি, কে তিনি যে আসবেন দুনিয়ায়? ঈসা হৃদয়ের পূর্ণ আনন্দ নিয়ে জওয়াব দিলেন, তিনি মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। (অধ্যায় ১৩)
পৃথিবীর এমন কোন ব্যক্তির সন্ধান মিলবে না যার আগমনের ভবিষ্যতদ্বাণী এভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে রাসূল (সা.)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীকে একটি মুজিযা ব্যতিত আর কি বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে?