অস্ট্রেলিয়ার একজন নামকরা ব্যবসায়ী। ইসলামকে নতুনভাবে তুলে ধরার একজন উদ্যমী রূপকার। ইসলামের শৈল্পিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামের আগমন ও বিস্তার তুলে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি মিউজিয়াম। দেশটির মেলবোর্নে অবস্থিত এই মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে ইসলামের নানা বিরল শিল্পকর্ম। পাঁচটি গ্যালারিতে সন্নিবেশিত এই মিউজিয়াম অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি অবদান।
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর মেলবোর্নের থোর্নবাড়িতে স্থাপিত হয়েছে ‘ইসলামিক মিউজিয়াম অব অস্ট্রেলিয়া’ (আইএমএ)। ইসলামের ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম এবং ইসলামী ইতিহাসের গতিধারা তুলে ধরার একটি অনবদ্য প্রয়াস এটি। এই প্রতিষ্ঠানে সন্নিবেশিত হয়েছে ইসলামী শিল্পকর্মের বর্ণিল আয়োজন। যেমন—ইসলামী স্থাপত্য শিল্প, ক্যালিওগ্রাফি, চিত্রশিল্প, গ্লাস, সিরামিক এবং বস্ত্রশিল্পের বৈচিত্র্যময় প্রদর্শনী।
আইএমএর পাঁচটি স্থায়ী গ্যালারি যেসব নামকরণে সাজানো হয়েছে, তা হলো : ১. ইসলামিক বিশ্বাস গ্যালারি, ২. ইসলামী সভ্যতার অবদান, ৩. ইসলামিক শিল্প, ৪. স্থাপত্য শিল্প এবং ৫. অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এসব গ্যালারি পরিদর্শনে যেকোনো পর্যটক ইসলামের সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অস্ট্রেলীয় মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা লাভে সক্ষম হবে। গ্যালারিতে আছেন সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, যাঁরা গ্যালারির বিষয়গুলো সম্পর্কে যে কাউকে ধারণা দিতে পারেন। ইসলামী সভ্যতার অবদানবিষয়ক যে গ্যালারি আছে, সেখানে ইসলামের সোনালি যুগে মুসলমানদের অবদানের নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। স্বর্ণালি যুগে চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল বিভাগ, রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতিবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোলশাস্ত্রে মুসলমানদের অনন্য অবদানের বিষয়গুলো এই গ্যালারিতে সুনিপুণভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। ইসলামিক শিল্পকর্ম গ্যালারিতে মুসলিম সভ্যতার শিল্পকর্ম যেমন—শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিভিন্ন শিল্প ঐতিহ্য, রাজনীতি ইত্যাদি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আর ইসলামিক স্থাপত্য শিল্প গ্যালারিতে মুসলিম যুগের মুসলিম এমনকি অমুসলিম স্থাপত্য শিল্পগুলোর তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে, যাতে যেকোনো পর্যটক বা আগতরা সেগুলো দেখে চমত্কৃত হন এবং ইসলামী স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারেন। তবে সবচেয়ে মজার এবং আকর্ষণীয় হচ্ছে অস্ট্র্রেলিয়ার মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিষয়ক গ্যালারি। এই গ্যালারির পরতে পরতে অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামের আগমন, বিকাশ এবং সেখানকার মুসলমানদের ঐতিহ্য ও জীবনাচরণ ফুটে উঠেছে। এখানকার ইন্টারপ্রিটারের মতে, অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে ১৭ শতকে। কাশ্মীরের উট ব্যবসায়ী দোস্ত মুহাম্মাদ তাঁর উটের পাল নিয়ে ১৮৬০ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় গমন করেন। তাঁর মাধ্যমে দেশটিতে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। তা ছাড়া এর কাছাকাছি সময় ইন্দোনেশিয়ার মাকাসসার থেকে একদল মুসলিম জেলে অস্ট্রেলিয়ায় গমন করেন। তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এসব তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছে এই গ্যালারিতে। তা ছাড়া ১৯ শতকে আফগানিস্তান, ভারত এবং পাকিস্তান থেকে আগত মুসলমানরা কিভাবে দেশটিতে গমন করেন এবং ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখেন তারও চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই গ্যালারিতে। এসব দেশের মুসলমানরা প্রধানত পরিবহন, খনিজ এবং পণ্য সরবরাহ সেক্টরে কাজ করে এবং অস্ট্রেলিয়ার মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান। তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অস্ট্রেলিয়াবাসীর মধ্যে প্রভাব বলয় তৈরি করে এবং ধীরে ধীরে সে দেশের মানুষ ইসলামে আকৃষ্ট হতে থাকে।
বলা আবশ্যক যে আফগান, ভারত ও পাকিস্তানের মুসলমানরা আধুনিক অস্ট্রেলিয়া বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় সাত লাখের মতো মুসলমান। এর আগে ২০০৩ সালের দিকে মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লাখ।
আইএমএতে মহানবী (সা.)-এর জীবনীর ওপর অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেটি গত ৬ মার্চ সমাপ্ত হয়েছে। এতে থ্রিডি মডেলের অডিও ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর জীবনের নানা দিক, তাঁর মদিনাজীবন, সেখানকার বিভিন্ন উপজাতির বিভিন্ন লোকেশন, মহানবী (সা.)-এর উটের কাফেলার চিত্র, আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর বাড়ি, পরিখার যুদ্ধের অবস্থান, মসজিদে নববি, হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘর, প্রথম কেবলা, মক্কায় মহানবী (সা.)-এর বাড়ি, কাবাঘর, বদরের প্রান্তর, নবীজির মদিনায় হিজরত প্রভৃতি বিষয় প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়াও আইএমএ নিয়মিত ক্যালিওগ্রাফি, চিত্রকর্মসহ নানা বিষয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
এসব অনুষ্ঠান অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালিত হয় এবং সেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইসলামিক মিউজিয়াম দেশটির মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য লালন, ধর্মীয় আচারকে পরস্ফুিট এবং ইসলামী মূল্যবোধ দেশটির অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, এই মহতী উদ্যোগ অস্ট্রেলিয়ায় ইসলাম প্রচারে অসামান্য অবদান রাখবে এবং দেশটিতে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করবে।