এবারের ঈদ টা সবার কাছে একটু অন্যরকম। করোনার ভীতি সবার ভিতরেই। এই করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে রোজার পুরো মাসেই রোজাদারদের ইফতার বিতরণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও সিনেট সদস্য, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীদের উপ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক, সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিলোত্তমা সিকদার। সনাতন ধর্মাবলম্বী হয়েও রোজাদারদের মধ্যে ইফতার বিতরণ করে নজর কেড়েছেন তিনি।
বরিশালের মানুষের কাছে নামটি খুব একটা পরিচিত নয়। তিলোত্তমা শিকদার কাটপট্টি এলাকার বাসিন্দা ও সমাজসেবক হিরেন সিকদারের মেয়ে। পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে। তিলোত্তমা সিকদার রমজানের প্রথম দিন থেকে ১০০ রোজাদারদের জন্য ইফতার বিতরণ করেছেন। কখনো ১৫০ আবার কখনো ২০০ কিংবা তার বেশি। এবার ঈদেও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে ঈদের জামা নিয়ে উপস্থিত হন তিনি।
আমাদের দেশে এমন নিদর্শন খুব কম দেখা গেলেও তিলোত্তমার এমন কর্মকান্ডে সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকছেন তিনি আলোচনার শীর্ষে। এক ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের সাথে ঈদ শেয়ার করার কিছু ছবি পোস্ট করেন যা মূহুর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। নিচে স্ট্যাটাসটি সম্পূর্ন তুলে ধরা হলোঃ
“এবার ঈদ সবার কাছেই অচেনা। কেউ পরিবার নিয়ে ঘরবন্দী হয়ে ঈদ পালন করছেন আবার কেউ কেউ দূরে থেকে ইচ্ছে সত্ত্বেও পরিবারের কাছে যেতে পারছেননি। কিন্তু আজ আমি এমন কিছু মানুষের সাথে ঈদ পালন করেছি যাদের সেই ঘরটাই নেই।
অনেকের মা নেই বাবা নেই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এমন শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে দিয়েছি নিজ হাতে। ঘরে রান্না করা ঈদের দিনের খাবার তাদেরকে খাইয়েছি।
১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের দিনটি ছিল ২০ নভেম্বর।
এর চেয়ে কঠিন ঈদ আর আসবেনা। প্রতিটা মানুষ ছিল ভয়ে এই বুঝি পাক আর্মি এলো!
যে সব মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বাইরে সীমান্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিলেন তারাও বুঝতে পারেননি কবে ঈদের দিনে। দেশ স্বাধীন করার নেশা ছাড়া তাদের মাথার আর কিছু ছিলনা। একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল মেঘালয়ে , ঘণ জঙ্গল, সাপ বিচ্ছু জোক আর চারপাশে বিশাল বিশাল গাছ। অনেক দূর থেকে খাবারের পানি আনতে হত। প্রতিবেলা খাবার ঠিকমত মিলতনা।
অথচ এই ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের বেশীর ভাগ দেশের সব চেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের । তারা খাবারের জন্য এত কষ্ট এর আগে করেনি। এই ক্যাম্পে খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে একদিন দেওয়া হল মাংস। মাংস পেয়ে সবাই এত্ত খুশি হয়েছিল যে সবাই জানতে চাইল আজ মাংস কিভাবে এল? তখন একজন উত্তর দিল “আজ তো ঈদ”। মুক্তিযোদ্ধা্রা এত দিন পরে ভাল খাবার পেয়ে তা মুখে নিতে পারেননি। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। কারণ একটাই দেশে মা-বাবা সবাইকে রেখে গেছেন তারা কি এই ঈদের দিনে বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন কেউ জানেননা।
৭১ এর ভয়ংকর ঈদের দিন ঢাকা ছিল ভুতুরে নগরী , সারা দেশ ছিল আতঙ্কে। এ নিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে বর্ননা দিয়েছেন শহীদ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি লিখেছেন, ‘আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামা কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার কাপড় কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতর দান। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমির কোনো সহযোদ্ধা আসে এই বাড়িতে? তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’
আমাদের সবার সুদিন ফিরবে। করোনা আমাদের ভালবাসার কাছে হার মেনে একদিন চলে যাবে কিন্তু যে কলিগুলো ফুল হয়ে একদিন সৌরভ ছড়াবে সেই শিশুদের কি হবে? আজকে ঈদের দিনে তাদের আলাদা কোন আনন্দ নেই। দুই বেলা খাবারের নিশ্চয়তাই কেউ তারা জীবনের অর্জন মনে করে। আমার দেওয়া নতুন জামা আর একবেলা খাবারে তাদের মধ্য বাড়তি আনন্দ দেখে আমি তৃপ্তি পেয়েছি। আবার হতাশ হয়েছি এই বয়সের অন্য শিশুরা কত আনন্দে আছে , পরিবারের সাথে ঘুরতে যেতে না পেরে আফসোস করছে আর এরা ?
এই আঁধার কেটে যাক আর করোনা আমাদের যে মানবতা শিখিয়েছে সেটুকু রয়ে যাক। ঈদ সবার জীবনে প্রকৃত আনন্দ নিয়ে আসুক।।
“ঈদ মোবারক”!!”