মাত্র ১৫ হাজার টাকায় ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাঁকে খুন করানো হয়। আর খুনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন তাঁরই সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ওরফে সেলিম। আদালতে অভিযুক্ত শাহিন ও হাবিবের দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর খুনের পুরস্কার হিসেবে শাহিনকে ৫ হাজার ও হাবিবকে ১০ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া একজন রিকশাচালকের মুঠোফোন দিয়ে টেলিফোন করার বিনিময়ে তাঁকে ১০০ টাকা দেন।
প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তাতে ধারণা করা যায়, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যা।
প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার ঘটনাটি ঘটে ১১ মে। মিরপুর ২ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত তাঁর বাসা থেকে সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি।
দেলোয়ার হোসেন যে মাইক্রোবাসে অফিসে যান সেটি নিয়ে এসেছিলেন তাঁরই সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভাড়াটে খুনি শাহিন ও গাড়িচালক হাবিব। আনিছুর ও শাহিনের পরনে পিপিই ছিল।
করোনা সংকটের কারণে জরুরি সেবায় নিয়োজিত অনেকেই পিপিই ব্যবহার করেন। তাই কেউ তাঁদের সন্দেহ করেননি।
গাড়িটি প্রকৌশলী দেলোয়ারের বাসার সামনে গাছের নিচে থামার আগে আনিছুর এক রিকশাচালকের মুঠোফোন থেকে তাঁকে কল করে নিচে আসতে বলেন। তাঁর কাছে মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও সেটি ব্যবহার করেননি। প্রমাণ রেখে যেতে চাননি। তবে অপরাধী যতই চালাক হোন, মনের অজান্তেই প্রমাণ রেখে যান। আনিছুর যে রিকশাচালকের মুঠোফোন ব্যবহার করেছেন, সেই রিকশাচালককে পুলিশ আটক করেই খুনের রহস্য উদঘাটন করে।
ভাড়াটে খুনি শাহিনের জবানবন্দি অনুযায়ী, গাড়িটি রূপনগর বেড়িবাঁধে উঠতেই আনিছুর তাঁকে ইশারা দেন এবং তিনি (শাহিন) পেছন থেকে প্রকৌশলী দেলোয়ারের গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেন। এ সময় আনিছুরও তাঁকে হত্যার কাজে সহায়তা করেন। যখন তাঁরা নিশ্চিত হলেন দেলোয়ার মারা গেছেন, তখন উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের একটি খালি প্লটে তাঁর মরদেহ ফেলে চলে যান।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নাবিদ কামাল বলেন, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ (উদ্দেশ্য) বের করতে পারেননি।
আনিছুর কেন তাঁর নির্বাহী প্রকৌশলী খুন করলেন, তার নেপথ্যে আরও কেউ রয়েছে কি না, তা জানতে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তা ও সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রকৌশলী দেলোয়ারকে মাইক্রোবাসে তোলার সময় এক ব্যক্তি সাদা সুরক্ষাপোশাক (পিপিই) পরা ছিলেন।
আনিছুর প্রথমে দাবি করেছিলেন, ঘটনার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে বাসায় ছিলেন। তাঁর বাসার সামনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ১১ মে সকালে সাদা পিপিই ও কালো জুতা পরে তিনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন। প্রকৌশলী দেলোয়ারকে যেখান থেকে মাইক্রোবাস তোলা হয়, সেখান থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্যের সঙ্গে আনিছুরের বাসার সামনের ফুটেজের মিল রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকল্পের বিল প্রদান নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ারের সঙ্গে তাঁর সহকারী প্রকৌশলীদের দ্বন্দ্ব ছিল। দেলোয়ার অনেক ত্রুটিপূর্ণ কাজের বিল আটকে দেন। এতে তাঁর সহকারী প্রকৌশলীরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা তাঁকে বিল দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে গত সেপ্টেম্বরে তাঁকে ওএসডি করা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তকে সহকর্মীরা তাঁদের বিজয় হিসেবে মনে করেছিলেন। গত জানুয়ারিতে আবার তাঁকে কোনাবাড়ী অঞ্চলে পদায়ন করা হলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হন এবং এই হত্যাকাণ্ড তারই পরিণতি বলে ধারণা করা যায়। একজন সৎ প্রকৌশলী হিসেবে দেলোয়ারের সুনাম ছিল। এর আগে নারায়ণগঞ্জেও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
প্রকৌশলী দেলোয়ার ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর তিন সন্তান স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেন, স্ত্রী গৃহবধূ। সত্যিকার অর্থেই পরিবারটি এখন সহায়হীন হয়ে পরেছে ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি করপোরেশনে নিম্নমানের উন্নয়নকাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শতকোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কোনাবাড়ী এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৩৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। জাইকা, এডিবি ও আরও একটি দাতা সংস্থার নামে পৃথক বিল তৈরি করা হয়। অর্থাৎ মোট ৯৯ কোটি টাকার বিল করা হয়। একই কাজ পৃথক তিনটি সংস্থার নামে বিল উত্তোলনের বিষয়টি দেলোয়ার আটকে দেন। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় সুপেয় পানির লাইন স্থাপনে শত কোটি টাকার একটি বিল তিনি অনিয়মের অভিযোগে আটকে দেন। এই কারণেই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার বিচার ও খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শনিবার বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক বিবৃতি দিয়ে বলছেন, ‘ঘুষের বিনিময়ে শতকোটি টাকার কাজের ফাইল ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দীর্ঘ পরিকল্পনার পর নিজ গাড়িচালকের সহায়তায় প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ঘটনা একটি অশনিসংকেত।’ বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও প্রকৌশলী ইনস্টিটিউশন হত্যার নিন্দা ও বিচার দাবি করেছে।