প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে এ দেশে।
এজন্য একমাস আগে থেকেই নেওয়া হতো প্রস্তুতি। শ্রীজগন্নাথ দেব, বোন সুভদ্রা রাণী ও ভাই বলরামকে নিয়ে পথপরিক্রমায় ব্যবহৃত রথ সংস্কার বা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
তবে এবার বৈশ্বিক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি মহামারি করোনা সংকটময় সময়ে সেই ব্যস্ততা নেই, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আয়োজন করা হয়েছে রথোৎসব। চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ১৮শ খৃষ্টাব্দের পর রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন শুরু হয়।
‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।/পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,/মূর্তি ভাবে আমি দেব-হাসে অন্তর্যামী।’ কবিগুরুর এ কবিতার ছন্দপতন ঘটছে এবার। করোনাকাল পাল্টে দিয়েছে সবকিছু।
কেন্দ্রীয় রথযাত্রা উৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে নন্দনকানন থেকে এখনও প্রতিবছর উদযাপিত হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব। এ উপলক্ষে তুলসীধামে আয়োজন করা হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি। সুদৃশ্য রথে চড়িয়ে ত্রিদেবতা নিয়ে পথ পরিক্রমায় বাহির হতেন হাজারো ভক্তবৃন্দ। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে এবার রথ পরিক্রমা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
তুলসীধামের মোহন্ত শ্রীমৎ দেবদীপ পুরী মহারাজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শহরে দুইশ বছরেরও প্রাচীন এই রথযাত্রার প্রবর্তক শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। তাঁর প্রয়াণের পর শ্রীমৎ স্বামী অচ্যুতানন্দ পুরী মহারাজ এবং পরবর্তীতে ঋষিপুত্র শ্রীমৎ স্বামী নারায়ণ পুরী মহারাজ সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। যা চলছে আজও। করোনাকালে ভক্তসমাগম না করতেই মঙ্গলবার রাজপথে মহাশোভাযাত্রা সহকারে রথপরিক্রমা হচ্ছে না। তবে ধর্মীয় নিয়ম মেনে পুরোহিত মন্দির প্রাঙ্গণে পূজা, বিগ্রহ নিয়ে পরিক্রমা করবেন। পাশাপাশি চলবে উপাসনা, ভোগারতি ও বিশ্ববাসীর কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা।
একই কথা জানালেন আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ শ্রীপাদ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে নগরে ইসকনের উদ্যোগে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য নিষ্টুলা দাস ব্রহ্মচারী ও চট্টগ্রাম ইসকনের অন্যতম রূপকার শ্রীপাদ শ্রীহরি দাস অধিকারী রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। নগরের জেএমসেন হলে বাঁশের তৈরি রথে মাঝখানে জগন্নাথ, একপাশে বড় ভাই বলরাম ও মাঝে বোন সুভদ্রা মহারাণীকে বসিয়ে রথ পরিক্রমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রবর্তক মন্দির থেকে ২০০৩ সালে বৃহৎ পরিসরে তিনটি সুদৃশ্য রথ নিয়ে শুরু হয় এ উৎসব।
তিনি জানান, প্রতিবছর রথযাত্রায় ৭-১০দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি থাকতো। বরেণ্য অতিথিরা আসতেন। কিন্তু করোনার কারণে এবার এসব আয়োজন হচ্ছে না। ভগবান জগন্নাথ দেবের রথ ‘নন্দীঘোষ’, শ্রীবলরামের রথ ‘তালধ্বজ’ ও সুভদ্রা মহারাণীর রথ ‘দর্পদলন’ রাজপথে যাচ্ছে না। ভক্তরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মন্দিরেই বিগ্রহ দর্শন করবেন। এছাড়া মন্দিরেই ধর্মীয় আচারাদি পালন করা হবে।
নন্দনকানন শ্রীশ্রী রাধামাধব মন্দির ও গৌরনিতাই আশ্রমের আয়োজনে বিভাগীয় ইসকনের উদ্যোগে গত ৪ বছর ধরে আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব। এছাড়া চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার মধ্যে অধিকাংশ থানা এলাকার মন্দির কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে প্রতিবছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসলেও এ বছর তা বন্ধ রাখা হচ্ছে।
ইসকন জাতীয় কমিটির সদস্য ও নন্দনকানন শ্রীশ্রী রাধামাধব মন্দিরের সেবায়েত মুকুন্দ ভক্তি দাস ব্রহ্মচারী সংবাদসেবীদের বলেন, করোনার কারণে বাইরে রথযাত্রা হচ্ছে না। তবে মন্দিরে অনুষ্ঠানাদি চলবে। এছাড়া ভার্চ্যুয়াল ধর্মসভায় মিলিত হবেন কৃষ্ণসেবকরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামী ১ জুলাই উল্টো রথযাত্রাও অনুষ্ঠিত হবে একই নিয়মে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব দে গণমাধ্যম কর্মীদেরকে বলেন, ভার্চ্যুয়াল সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্দির আঙ্গিনায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে রথ টানা সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কোনও অবস্থাতেই জনসমাগমের কারণে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত নির্দেশনা যেন উপেক্ষিত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রথযাত্রা উৎসব পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।