সিরাজুর রহমানঃ ১৬ই জুন ২০২০ চীন ও ভারতের মধ্যে থাকা লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) এ সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি এক ভয়াবহ রকমের প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক সেনা হতাহত হওয়ার মধ্য দিয়ে লাখাদ অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রমের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে দেশ দুটির মাঝে চরম বিরোধ ও সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। বলে যেতে পারে ১৯৬২ সালের ভয়াবহ যুদ্ধের পর উভয় পক্ষের মধ্যে কোন রকম সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ না হলেও ভারত ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার পাশ্ববর্তী দেশগুলোর উপর নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছে না চীন ও ভারত। তাছাড়া বর্তমানে দেশ দুটি সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে চরম পর্যায়ে একে অপরকে দোষারোপ করার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সীমান্তে এক রকম নিরবেই ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি ও সেনা সমাবেশ করে যাচ্ছে ভারত ও চীন।
তবে ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে যে যাই বলুক বা মনে করুক না কেন, আপাতত দৃষ্টিতে ভারত ও চীনের মধ্যে স্বল্প পরিসরে বা ব্যাপক আকারের সরাসরি সীমান্ত সংঘর্ষ কিংবা পূণাঙ্গ যুদ্ধের কোন সমুহ সম্ভবনা আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া উদীয়মান এশিয়ার দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীন ও ভারত এ মুহুর্তে বাস্তবিক অর্থে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ানোর মতো কোন শক্ত অবস্থানে আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত বা চীনের পক্ষে অপ্রচলিত পারমানবিক অস্ত্র প্রয়োগের মতো ভয়াবহ ঝুঁকি নেয়া এক কথায় অসম্ভব। যদিও এ মুহুর্তে চীনের অস্ত্র ভান্ডারে ৩২০টি এবং ভারতের অস্ত্র ভান্ডারে ১৪০টি বা তার বেশি সংখ্যক নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড মজুত থাকতে পারে।
আপাতত দৃষ্টিতে চীনের সামরিক সক্ষমতা ও বার্ষিক বাজেট ভারত অপেক্ষা পাঁচগুন বেশি হলেও ভূ-রাজনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থান জনিত কারণে চীন কোন অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে ৪০% এর সামরিক শক্তি ভারতের বিরুদ্ধে মোতায়েন বা প্রয়োগের কোন সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। কারণ বিগত দুই দশক ধরে বিশ্বের উদীয়মান সামরিক পরাশক্তি রেড জায়ান্ট চীনের দক্ষিণ চীন সাগরের শতভাগ মালিকানা দাবি নিয়ে বিরোধ এবং পূর্ব চীন সাগরের একাধিক দ্বীপ নিয়ে সাগর সংলগ্ন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানসহ আটটি দেশের সাথে দীর্ঘ মেয়াদে চরম উত্তেজনা ও বিবাদে জড়িয়ে রয়েছে। তাছাড়া বরাবরের মতো বিশ্বের এক নম্বর সামরিক সুপার পাওয়ার ও কূটকৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এই অস্থিতিশীল সামরিক উত্তেজনার সুযোগে বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া এবং চীনকে সামরিক ও কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করার জন্য গোটা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ইতোমধ্যেই ব্যাপক আকারের সামরিক সমাবেশ অনেক আগেই সুসম্পন্ন করে রেখেছে।
এদিকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নিয়মিতভাবেই জোটভুক্ত দেশগুলোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া ও নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারি এবং সামরিক পেশিশক্তি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। অর্থ্যাৎ এক্ষেত্রে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগর ইস্যুতে চীনের যুদ্ধে জড়ানোর অর্থই হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের উত্তর কোরিয়াসহ তিন চারটি দেশ বাদে অধিকাংশ দেশ এবং বিশ্ব শান্তির মহানায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক নেভাল ও এয়ার ফ্লীটের সরাসরি মোকাবেলা করা। আর তাই চীনকে নিশ্চিতভাবে তার সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতার ৬০% পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগর সংলগ্ন স্থল ও সমুদ্র সীমান্তে যুদ্ধ হোক বা না হোক এক রকম বাধ্য হয়েই কিংবা কৌশলগত কারণে সার্বোক্ষণিক মোতায়েন রাখা ব্যাতিত আপাতত বিকল্প কোন রাস্তা খোলা থাকছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে অস্থিতিশীল কাশ্মির উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে পাকিস্তানের চলমান ভয়াবহ ও দীর্ঘ মেয়াদী সীমান্ত সংঘর্ষ যে কোন মুহুর্তে বড় আকারের যুদ্ধে রুপ নিতে পারে, এমন আশাঙ্খায় ভারতকে তার সামরিক শক্তির একটি বড় অংশ সুবিশাল পাকিস্তান সীমান্ত জুড়ে মোতায়েন রাখতে হচ্ছে এবং অব্যাহত ভাবে প্রতি নিয়ত সীমান্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। তাছাড়া ভারতের দেয়া এক তথ্যমতে, জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩০শে জুন ২০২০ পর্যন্ত পাকিস্তান একাধারে দুই হাজার বার বা তার কাছাকাছি কাশ্মীরে লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর সীমান্ত হামলা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে চীন কিন্তু নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের মাধম্যে এক ধরণের ছায়া যুদ্ধ ও মনস্তাত্বিক চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করেছে এবং ভারত ভবিষ্যতে চীনের সাথে যে কোন ধরণের যুদ্ধে লিপ্ত হলে পশ্চিমে থাকা পাকিস্তানের বিশাল সীমান্ত অঞ্চল ভয়াবহ রকমের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। আর তাই ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একই সাথে হয়ত চীন ও পাকিস্তানকে যুগৎপত ভাবে মোকাবেলা করতে হতে পারে।
আমরা যদি ভারত ও চীনের সামরিক সক্ষমতা ও ভারসাম্য তুলনা করি, তাহলে সব দিক বিবেচনায় চীনকে অবশ্যই এগিয়ে রাখতে হবে। মুলত, চীনের গ্রাউন্ড ও নেভাল ফোর্স নিশ্চিতভাবে ভারত অপেক্ষা অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আক্রমনাত্বক বলা চলে। আবার অন্য দিকে চীন ও ভারতের ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সমুদ্র পথে দেশ দুটির মাঝে যুদ্ধের কোন সম্ভবনা কম থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে চীন কিন্তু ভারত মহাসাগরে তার গোপন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন মিশন পরিচালনা ও নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। যদিও সঙ্গত কারণে সমুদ্র পথে ভারত মহাসাগরে চীনের সাবমেরিন ভিত্তিক নেভাল ফ্লীটের ভারত আক্রমন করা বা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এক কথায় অসম্ভব। তাছাড়া চীনের নৌবাহিনীতে দুটি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার থাকলেও বাস্তব যুদ্ধে এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারের ব্যবহার ও অভিজ্ঞায় চীন এখনো কিন্তু ভারত অপেক্ষা যথেষ্ঠ পিছিয়ে রয়েছে। যদিও চীন ইতোমধ্যেই তাদের নিজস্ব উৎপাদিত দ্বিতীয় এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার পরীক্ষামুলক ভাবে সাগরে নামিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং চীন আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এ রকম আরো নতুন দুটি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার নেভাল ব্যাটল গ্রুপে অন্তভুক্ত করতে এক রকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এদিকে এ মুহুর্তে ভারতের নেভাল ফ্লীটের অন্যতম প্রধান ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রনতরী হচ্ছে ৪৫ হাজার টনের আইএনএস বিক্রমাদিত্য। রাশিয়া থেকে কেনা এই মিডিয়াম আকারের এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারটি ২৪টি করে মিগ-২৯কে জেট ফাইটার এবং ৬টি করে এএসডাব্লিউ/এইডাব্লিউ হেলিকপ্টার বহন করতে পারে। রাশিয়ার কাছ থেকে ২৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকায় কেনা এই এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারটি ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নৌ বাহিনীতে কমিশনিং লাভ করে। তাছাড়া ভারত সরকার ভবিষ্যত পরিকল্পনার আওতায় ২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে তাদের নৌ বহরে মোট তিনটি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার সংযোজন করতে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং যার মধ্যে কমপক্ষে একটি থাকবে নতুন প্রজন্মের ৬০,০০০ টনের পারমানবিক শক্তিচালিত এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিশাল।
তবে এখানে চীনের গ্রাউন্ড ফোর্সের আর্টলারি সিস্টেম ও ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা ভারতের জন্য অবশ্যই এক বড় ধরণের হুমকী ও মারাত্বক চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া চীনের অস্ত্র ভান্ডারে হাজার হাজার স্বল্প, মাঝারি ও দূর পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্রসহ পারমানবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ৮০০টি হতে পারে। যেখানে ভারতের কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্রের সংখ্যা ২০০টি বা তার কাছাকাছি থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে ভারত খুব সম্ভবত চীন সীমান্তে অজানা অসংখ্য ব্রক্ষ্মস ক্রুজ মিসাইল এবং নিজস্ব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেছে। অন্যদিকে চীন ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানকে প্রতিহত করতে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে রেখেছে বলে প্রতিয়মান হয়।
সব দিক বিবেচনা করলে চীনের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশ দূর্বল ও স্পর্শকাতর। চীনের বিমান বাহিনীতে মোট ৩১০০টি বা তার কাছাকাছি সামরিক পরিবহণ, যুদ্ধবিমান, বোম্বার ও হেলিকপ্টার থাকলেও কিন্তু এখনো পর্যন্ত হাজার খানেক ষাট ও সত্তর দশকের জে-৭, জে-৮ এবং জেএইচ-৬ লাইট গ্রাউন্ড এট্যাক দিয়ে ভর্তি। যদিও চীনের বিমান বাহিনীতে ২০৫টি জে-১১, ৭৫টি এসইউ-২৭, ৭৩টি এসইউ-৩০ এবং ৩২৩টি জে-১০ এক্টিভ যুদ্ধিমান রয়েছে। আবার ভারতের বিমান বাহিনীতে ২১০০ এর বেশি যুদ্ধবিমান, সামরিক পরিবহণ বিমান ও হেলিকপ্টার থাকলেও তাদের অতি পুরোনো ছয় থেকে সাত শতাধিক যুদ্ধবিমান এখন বাতিল হবার পথে। তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের বিমান বহরে থাকা চতুর্থ প্রজন্মের বিশাল আকারের ২৭২টি এসইউ-৩০এমকেআই জেট ফাইটার ফ্লীট কিন্তু চীনের জন্য এখনো পর্যন্ত মারাত্বক হুমকি হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
তাছাড়া গত ২ জুলাই ২০২০ (বৃহস্পতিবার) ভারতের চীর বৈরী রেড জায়ান্ট চীন এবং পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকি এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মোট ৩৮,৯০০ কোটি ভারতীয় রুপী বা ৫.২০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যায়ে আপদকালীন প্রয়োজনে ২১টি মিগ-২৯, ১২টি এসইউ-৩০ এমকেআই জেট ফাইটার ক্রয়ের পাশাপাশি মিসাইল সিস্টেম এবং প্রয়োজনীয় ডিফেন্স হার্ডওয়ার সিস্টেম সংগ্রহে অর্থ ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে ২১টি মিগ-২৯ ক্রয়ের পাশাপাশি বহরে থাকা সম্পূর্ণ মিগ-২৯ ফ্লীটকে ইউপিজি ভার্সনে আপগ্রেডেড করার জন্য ৭,৪১৮ কোটি রুপী এবং ১২ নতুন এসইউ-৩০ এমকেআই ক্রয়ের জন্য ১০,৭৩০ কোটি রুপী বা মোট ২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ আপদকালীন অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে ভারতের মোদি সরকার।
এদিকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীন সাধারণত তাদের সামরিক বাজেটের সঠিক তথ্য প্রকাশ না করলেও, ২০১৯ সালে তাদের নিজস্ব সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট ৩২১ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে। এদিকে ভারতের ২০১৯ সালের সামরিক বাজেট বরাদ্দ ছিলো ৫৬.০০ বিলিয়ন ডলার যা ২০২০ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌছে যেতে পারে। আবার ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইনিস্টিউটের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ভারতের সামরিক বাজেট ছিল ৭১.১০ বিলিয়ন ডলার। আবার প্রতিবেদনে ২০১৯ সালে চীন সামগ্রিকভাবে ২৬১.০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে। যা কিনা ২০১৮ সাল অপেক্ষা ৫.১০% বেশি। তাছাড়া দেশটি সামরিক গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক ব্যয় করে। চীন তার মোট জিডিপির ১.৯% সরাসরি ব্যয় করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাত গবেষণা, উন্নয়ন ও পরিচালনায়। তাছাড়া চীর বৈরি দুই পারমানবিক শক্তিধর প্রতিবেশি চীন ও পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে চরম সামরিক উত্তেজনা ও কৌশলগত চাপ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ভারত এক রকম বাধ্য হয়ে উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ক্রয় বা সংগ্রহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে।
ভারত তার নিজস্ব প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা শিল্প ও উৎপাদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষুদ্র যুদ্ধাস্ত্র, মিসাইল এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম তৈরি করে গেলেও ভারত কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার চাহিদার মাত্র ৩০% গোলাবারুদ বা এম্যুউনেশন তৈরি করতে সক্ষম এবং বাকী ৭০% পর্যন্ত গোলাবারুদের জন্য ইসরাইল, রাশিয়া কিংবা অন্য কোন দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই ভারত তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পকে কাজে লাগিয়ে প্রতিরক্ষার চাহিদা যথেষ্ট ভাবে মেটাতে পারছে না বিধায় এক রকম বাধ্য হয়েই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম আমদানি করছে বলে মনে করা হয়। অথচ এদিকে চীন তার প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র যুদ্ধাস্ত্র এবং গোলাবারুদের শতভাগ নিজেই তৈরি করে থাকে এবং এক্ষেত্রে চীনের গোলাবারুদ বা এমিউনেশন উৎপাদন ক্ষমতা ভারতের অপেক্ষা কমপক্ষে ৮ গুণ বেশি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত কিন্তু তার নিজস্ব কূটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইসরাইলের সাথে বৃহৎ পরিসরে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং এই তিন দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম সংগ্রহ করে যাচ্ছে ভারত। যা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে চীন ও পাকিস্তানকে এক ধরণের মনোস্তাত্বিক চাপে রাখবে। আর ভারত ও চীন সীমান্ত সংঘর্ষে কার কি লাভ বা ক্ষতি হলো তা বোঝা না গেলেও রাশিয়া, ফ্রান্স, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অস্ত্র ব্যবসার রাস্তা পরিস্কার হয়ে গেল। এখন এই সুযোগে যে যার মতো করে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বানিজ্য হাতিয়ে নিতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবে বলে মনে হয় না।
পরিশেষে ভয়াবহ যুদ্ধ এবং দীর্ঘ মেয়াদী অস্থিতিশীল সামরিক উত্তেজনা কিংবা পেশিশক্তি প্রদর্শন যে কোন সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। এটা অবশ্যি বিবাদরত চীন ও ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে। তাই অন্যের উস্কানীতে বা ফাঁদে পা না দিয়ে আলোচনার টেবিলে সকল সমস্যার সমাধান করা উচিত বলে আমি মনে করি। আর যুদ্ধকে ব্যাবহার করে কিংবা নিজ দেশের সেনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল কিম্বা ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা অনেক পুরনো এক কালচার হলেও দেশ ও মানুষের কল্যাণ ও নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ভয়ঙ্কর রীতি এবং কূটকৌশল আমাদের সকলকে আবশ্যিকভাবে পরিহার করে চলা উচিত।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com