রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার কাছে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেছিলেন বর্তমান মন্ত্রিসভার এক সদস্য। জানতে চাইলেন, আমি কোথায়। বললাম, শাহবাগে আছি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘নেত্রীকে আজ গ্রেপ্তার করা হবে। সুধা সদনে চলে আসেন।’ আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। তখন আমাদের কাছে এই ধরনের তথ্য প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে আসত। প্রথম প্রথম এ ধরনের তথ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতাম। চেষ্টা করতাম নানাভাবে খোঁজখবর নেওয়ার।
খবরটি ঠিক নয়। তাই তাঁর কথা বিশ্বাস না করে বাসায় গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই আবার সেই নেতার ফোন। জানতে চাইলেন, ‘সুধা সদনে এসেছেন?’ বললাম, আমি তো বাসায় চলে এসেছি। সেই নেতা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন, আমি না আপনাকে জানালাম আজ নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা হবে।’ এ ধরনের তথ্য কয়েক দিন ধরেই শুনে আসছি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি সত্য নয়, গুজব। এটা বলে আমি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন, আজকেই নেত্রী গ্রেপ্তার হবেন?’ তিনি বললেন, ‘নেত্রীর পুলিশ প্রটেকশন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের রাত ১২টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। রাজধানীর সব থানার ওসিকে রাত ১২টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ফোর্স নিয়ে
রাত ১২টা থেকে বিডিআরকে (বর্তমানে বিজিবি) শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল দিতে বলা হয়েছে। এর পরও কি নিশ্চিত হওয়া যায় না?’ তার পরও আমি নিশ্চিত হচ্ছি না দেখেই বোধ হয় জানালেন এই তথ্যটা, ‘তা ছাড়া স্বয়ং নেত্রীকেই বলা হয়েছে, আজ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’ এরপর আর ঘরে বসে থাকা চলে না।
শেখ হাসিনাকে সত্যিই তাহলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে? যেতে যেতে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। ইঙ্গিত অবশ্য আমরা পাচ্ছিলাম কয়েক দিন ধরেই। কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন তখন মারণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনা তাঁকে দেখে বেরিয়ে এসে জোরালো একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাতে কঠোর সমালোচনা ছিল সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার। গ্রেপ্তারের পর নেতাদের কাছ থেকে জোর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের।
নেতাদের কেউ কেউ তখনই বলতে শুরু করলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবার আর ছাড়বে না। মুখ বন্ধ করতে নেত্রীকে গ্রেপ্তার করবেই। এর পর থেকে প্রতিদিনই ছিল গুজবের ছড়াছড়ি। বিভিন্নভাবে খবর আসত, আজ শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। অনেকে নিশ্চিত করেও বলতেন। কাজেই আওয়ামী লীগ বিটের রিপোর্টার হিসেবে আমাদের দিন কাটছিল শঙ্কা ও উৎকণ্ঠায়। অফিস শেষে বাসায় গিয়ে গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত উৎকণ্ঠায় থাকতে হতো। নানা মাধ্যমে যখন নিশ্চিত হতাম, আজ গ্রেপ্তারের আশঙ্কা নেই, শুধু তখনই ঘুমাতে যেতাম। এই অবস্থার মধ্যে এলো ১৫ জুলাই।
রাত ১১টার দিকে আমি যখন সুধা সদনে পৌঁছলাম, সম্ভবত তখনো সবাই সংবাদটি জানতে পারেনি। কারণ সেখানে তখন মাত্র দুজন রিপোর্টার। চরম উৎকণ্ঠায় শুরু হলো আমাদের অপেক্ষার পালা। একে একে অন্য জাতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার ও ফটো সাংবাদিকরাও সুধা সদন এলাকায় এলেন। এসে উপস্থিত হলেন বেসরকারি বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশনের রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনরাও।
তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত সুধা সদন এলাকাটি কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে আটকে রেখেছিল। ফলে ওই এলাকায় বসবাসকারী এবং সুধা সদনের নির্দিষ্ট কিছু স্টাফ ছাড়া সাধারণের চলাচল ছিল বন্ধ। সে কারণে আমরা সংবাদকর্মীরা বেশ দূরে অবস্থান করছিলাম। সেদিন রাতের আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল। গভীর রাতে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। সেই সঙ্গে মশার কামড় সহ্য করছিলাম। আমরা সারাক্ষণই সজাগ ছিলাম। এভাবে রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। ফজরের আজানের কিছু আগে সিটি কলেজ-জিগাতলা সড়কের ঠিক মাঝখানের রাস্তা (সিটি কলেজের দিক হয়ে আসতে স্টার কাবারের পাশের গলির পরের গলি। বর্তমানে ওই রাস্তার মুখে ‘ডোমিনোজ পিত্জা’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে।) দিয়ে হঠাৎ তীব্র আলো জ্বেলে একটির পর একটি গাড়ি প্রবেশ করতে শুরু করল। গাড়িগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা সবাই নিশ্চিত হলাম, তারা সুধা সদনে আসছে। ঘটলও তাই, আমাদের কাছাকাছি এসে আরো দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারপর তাঁরা সুধা সদনে প্রবেশ করলেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন ফজরের নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তাঁদের নিচে অপেক্ষা করতে বলেন। এরই মধ্যে টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভবনে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী ও স্টাফদের নিচতলার একটি কক্ষে জমায়েত করা হয়। জব্দ করা হয় তাঁদের প্রত্যেকের মোবাইল ফোন। নামাজ শেষ করে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে শেখ হাসিনা মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ওপরতলায় ওঠেন। শেখ হাসিনা তাঁদের চা-বিস্কুট খেতে দিয়ে ফোন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তৎকালীন তথ্য ও আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে। তিনি ফোনে উপদেষ্টার কাছে জানতে চান, ‘এসব কী হচ্ছে?’ তেমন কোনো উত্তর ওদিক থেকে নেই, স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা তখন দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি খুব শিগগির মুক্ত হয়ে আসব।’ এর পরই তাঁর মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়।
বাইরে শতাধিক গাড়ির বহর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েক শ সদস্যকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। সবার অপেক্ষা শেষ করে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়ির বহর ঢাকার সিএমএম আদালতের উদ্দেশে রওনা হয়। যাওয়ার আগেই নেত্রী শেষ নির্দেশনা দিয়ে যান নেতাকর্মীদের।
তাঁকে বহনকারী গাড়ি চলে গেল সিএমএম কোর্টের দিকে, আর আমি রওনা দিই অফিসের দিকে। যদিও সকালবেলা পত্রিকায় তেমন কাজ নেই, তবু আমার পত্রিকাসহ অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে টেলিগ্রাম প্রকাশের।
ফিরতি পথে খুব বিষণ্ন লাগছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই অসম্মান তো পাওনা নয়। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এটা ভাবা অসম্ভব ছিল যে দুই বছরের কম সময়ের মধ্যেই তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। ক্ষমতায় আসবেন পর পর তিনবার।
এখন আবার সেই দিনটার স্মৃতিকেই অবিশ্বাস্য লাগে। ১৬ জুলাই এলেই পেছনে ফিরে যাই আর নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি এই ঘটনা ঘটেছিল!