সিরাজুর রহমান: বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এডভান্স মাল্টিরোল এপ্যাচী এএইচ-৬৪ এট্যাক হেলিকপ্টার হচ্ছে বিশ্বের বুকে সার্ভিসে থাকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং আধুনিক অস্ত্র সমৃদ্ধ একটি এট্যাক হেলিকপ্টার। মার্কিন এএইচ-৬৪ এট্যাক হেলিকপ্টারের প্রডাকশন লাইন ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু হয়ে এখনো পর্যন্ত চালু রয়েছে এবং আজ পর্যন্ত এ, বি, সি, ডি, ই এবং এফ ক্যাটাগরির প্রায় ২,৫০০ ইউনিট এ্যাপাচী এএইচ-৬৪ হেলকপ্টার তৈরি করা হয়েছে এবং চলতি জুলাই মাসের শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে ২,৫০০তম হেলিকপ্টারটি তুলে দেয়া হয়েছে।
এএইচ-৬৪ এ্যাপাচী হেলকপ্টার এডভান্স মাল্টিরোল মার্কিন সেনাবাহিনীতে প্রথম ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে সার্ভিসে আসে। তবে ১৯৯১ উপসাগরীয় যুদ্ধে এক গোপনীয় কমব্যাট মিশনে প্রথমবারের মতো ৮টি এ্যাপাচী এএইচ-৬৪ এট্যাক হেলিকপ্টার একত্রে কুয়েতে থাকা ইরাকের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস করে যুদ্ধ জয়ের যাত্রা শুরু করে। আর এভাবেই এ্যাপাচীর হাত ধরেই ১৯৯১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর এক উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা হয়।
মার্কিন সেনাবাহিনী বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটাগরির এরুপ ১১৭৫টি এডভান্স এএইচ-৬৪ এট্যাক হেলিকপ্টার ব্যাবহার করে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাতিত বিশ্বের ১৬টি দেশ বিভিন্ন ক্যাটাগরির এ্যাপাচী এএইচ-৬৪ এট্যাক হেলিকপ্টারের এক্সপোর্ট ভার্সন ব্যাবহার করে। তার মধ্যে জাপান, সৌদি আরব, ভারত, ইসরাইল, আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্য, কুয়েত এবং মিশর অন্যতম। তাছাড়া ১৭ তম দেশ হিসেবে মরক্কোর কাছে মোট ২৪টি এই জাতীয় এট্যাক হেলিকপ্টার ২০২৪ সালে প্রথম ব্যাচে হস্তান্তর করবে মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশন।
প্রতিটি বোয়িং এ্যাপাচী এএইচ-৬৪ এডভান্স মাল্টিরোল হেলিকপ্টারের আন্তজার্জাতিক বাজার মূল্য আনুমানিক ৪৫-৫০ মিলিয়ন ডলার। তবে ক্রেতা দেশের নিজস্ব চাহিদা মাফিক কাস্টমাইজড করা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র ক্রয়ের উপর এর দাম অনেকটাই নির্ভর করে। বিশেষ করে মিসাইল, এমিউনেশন, ট্রেনিং এবং স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ ও রিপিয়ার এণ্ড মেইন্টেনেন্সের মতো গুরত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তভূক্ত করে ক্রয় করা হলে এর দাম ৬২ থেকে ৬৫ মিলিয়ন কিংবা ৮০ মিলিয়ন ডলারে পৌছে যেতে পারে।
এদিকে ভারত কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন জায়ান্ট বোয়িং কর্পোরেশনের সাথে সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে ১.৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ওয়েপন্স এণ্ড মেইন্টেনেন্স প্যাকেজসহ ২২টি সুপার এডভান্স মাল্টিরোল এএইচ-৬৪ই এ্যাপাচি এট্যাক হেলিকপ্টার ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে। আর চুক্তি মোতাবেক মার্কিন বোয়িং ৩০শে জুন ২০২০ এর আগেই এরুপ ২২টি ভারতের বিমান বাহিনীর কাছে সরবরাহ সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া ৯৩০ মিলিয়ন ডলার চুক্তিমূল্যে ভারতের সেনাবাহিনীর নিজস্ব চাহিদা মাফিক প্রযুক্তি ও (মিসাইল, এমিউনেশন এণ্ড ট্রেনিং) আরো অত্যাধুনিক এ্যাপাচী এএইচ-৬৪ই এট্যাক হেলিকপ্টার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সরবরাহ করবে মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশন।
দুই জন ক্রু দ্বারা চালিত এডভান্স মাল্টিরোল এএইচ-৬৪ এ্যাপাচী এ্যাটাক হেলকপ্টারের দৈর্ঘ্য ১৪.৬৮ মিটার, উচ্চতা ৪.৭২ মিটার এবং রোটার ডায়ামিটার ৮৪ ফিট। খালি অবস্থায় এর ওজন ৬,৮৩৮ কেজি এবং অস্ত্র লোড অবস্থায় এর ওজন ১০,৪৩২ কেজি। এটির সর্বোচ্চ ফ্লাইট স্পীড ২৭৯ কিলোমিটার এবং সার্ভিস সিলিং ২০ হাজার ফিট এবং মেক্সিমাম রেট অফ ক্লাইম্ব ২,৮০০ ফিট পার মিনিট। দুটি টি-৭০০-জিই-৭০১সি টার্বো শ্যাফট ইঞ্জিন ও চারটি ব্লেড দ্বারা চালিত এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩০০ মাইল বা ৪৮০ কিলোমিটার। তবে এটি একবার ফুয়েল নিয়ে একাধারে ১,৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে সক্ষম।
উচ্চ প্রযুক্তির হেলমেট মাউনটেণ্ট ডিসপ্লে সজ্জিত এএইচ-৬৪ এ্যাপাচী এট্যাক হেলিকপ্টারের সম্মুখে ১,২০০ রাউণ্ডের ৩০ এমএম এম২৩০ চেইন গান সংযুক্ত করা আছে। এর সম্মুখে নোজ মাউনটেন্ট সেন্সর সুইট ফর টার্গেট একিউজেশন এণ্ড নাইট ভিশন সিস্টেম ইন্সটল করা রয়েছে এম২৩০ চেইন গানকে কার্যকরভাবে ব্যাবহার করার উদ্দেশ্যে। এটিকে দিনে-রাতে এবং যে কোন প্রতিকূল আবহাওয়ায় কমব্যাট মিশন পরিচালনার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। তাছাড়া চারটি হার্ড পয়েন্টে গ্রাউণ্ড এট্যাক মিশনের জন্য হাইড্রা ৭০ এমএম এবং সিআরভি-৭ ৭০ এমএম এবং এপিকেডাব্লিউএস ৭০ এমএম রকেট পড ব্যাবহার করে। এজিএম-১১৪ হেলফায়ার মিসাইল এআইএম-৯২ স্টিংগার এবং স্পাইক মিসাইল বহন করতে সক্ষম।
সেন্সর এবং এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে রয়েছে টার্গেট একুয়েজেশন ডিজিনেশন সিস্টেম, পাইলট নাইট ভিশন সিস্টেম। তাছাড়া প্যাসিভ ইনফ্রডেড কাউন্টারমেজারস, জিপিএস, জ্যামিং রেজিস্ট্যান্ট, এবং আইনএইচএডিএসএস সিস্তেমসহ বেশ কিছু অত্যাধুনি এভিয়নিক্স প্রযুক্তি ইন্সটল করা হয়েছে। রাডার হিসেবে লকহীড মার্টিন/নরথ্রপ গ্রুম্যান এর এ এন/এ পিজি-৭৮ লংবো ফায়ার-কন্ট্রোল রাডার সংযুক্ত করা হয়েছে।
তবে অদূর ভবিষ্যতে সতর্কতার সাথে স্টাডি একেবারেই কম মূল্যে নিন্ম মানের কিছু না এনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় এরুপ ১২-১৬টি সুপার এডভান্স মাল্টিরোল এ্যাপাচী এ এইচ-৬৪ই সিরিজের এট্যাক হেলিকপ্টার ক্রয় কিংবা সংগ্রহ করা হলে আমাদের সেনা ও বিমান বাহিনীর সক্ষমতা যথেষ্ঠ আকারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।