মহামারী সংক্রমণের প্রভাবে দেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করেছিলেন কেউ কেউ। সংক্রমণের প্রথম দিকে দোকানে দোকানে এমনকি বাসাবাড়িতে মজুদের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়।
বাজারে কোনো কোনো পণ্যের মূল্যও হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। এসব বাস্তবতায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেয় এবং প্রাথমিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার সফল হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কেননা এখন আর ওই ধরনের আশঙ্কার কথা কেউ বলছেন না। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এখন অনেকটাই কমে গেছে।
আগামীতেও খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি আমদানিও অব্যাহত রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে খাদ্যশস্যের ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। করোনাভাইরাস প্রেক্ষাপট সৃষ্টির শুরু থেকেই দেশের প্রতি ইঞ্চি কৃষি জমি কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়ে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সবাই তৎপর।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। সংগ্রহ বা আমদানিও হচ্ছে চাহিদা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। বাজার স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগাম বন্যায় আউশের কিছুটা ক্ষতি হলেও তা সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। বন্যা খুব দীর্ঘস্থায়ী না হলে আমনেরও ক্ষতি হবে না। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনেকে বেকার হওয়ায় দারিদ্র্য বেড়েছে। তবে তাদের টেনে তুলতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন দেশের মতো রেশন ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে সরকার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রেশন পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ মনে করেন, সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে চরম দরিদ্র কারা। তারপর চূড়ান্তভাবে এই শ্রেণির জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা হলে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। তিনি সমকালকে বলেন, এটি সত্যি যে, দুর্যোগের মধ্যেও কাউকে না খেয়ে মরতে হয়নি। তবে কম খেতে হয়েছে অনেককেই। ফলে পুষ্টিহীনতা বাড়ছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকা এবং খাদ্যশস্যের আমদানি অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে ইতিবাচক উল্লেখ করে অধ্যাপক আকাশ বলেন, খাদ্যশস্যের ঘাটতি না থাকা ভালো দিক। বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের হুমকি দেখা দিলেও দেশে সে অবস্থা হবে না। সরকার প্রথম থেকেই এ বিষয়ে সোচ্চার ছিল। বন্যার হুমকির মধ্যে দ্রুত ধান কাটার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কৃষি ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সুফলও মিলছে।
এবার সারাদেশে বোরো এবং আউশের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমনের লক্ষ্যমাত্রাও বেড়েছে। বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর। এখান থেকে প্রায় দুই কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার টন বোরো ধান উৎপাদন হওয়ার কথা। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে বোরোর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। খাদ্য নিরাপত্তায় বড় অংশ পূরণ করে বোরো। পাশাপাশি আউশেরও বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। গত মৌসুমের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দুই লাখ হেক্টর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ হেক্টর। তবে এর চেয়েও বেশি জমিতে চাষ হয়েছে এবার। ফলনও হয়েছে ভালো।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টন। আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯ লাখ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৫৬ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ছিল ১২ দশমিক ৬১ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১০ দশমিক ২৮ লাখ টন এবং গম ২ দশমিক ৩৩ লাখ টন।
চলতি বন্যায় কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। বন্যা বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলে আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে বিকল্প উপায়ে চাষাবাদ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন প্রতি বছর যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
করোনা দুর্যোগের মধ্যেও খাদ্য নিরাপত্তায় এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে চলতি অর্থবছরে চালের চাহিদা থাকবে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ টন এবং গমের চাহিদা থাকবে ৫৫ লাখ টন। সব মিলিয়ে দানাদার খাদ্যশস্যের চাহিদা থাকবে তিন কোটি ৭৫ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে উৎপাদন হবে তিন কোটি ৯৯ লাখ টন। ফলে প্রায় ২৫ লাখ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকবে।
এবার করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ সংকট হয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাও ভালোভাবে করা সম্ভব হয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। সরকার অর্থনৈতিক দিক থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে তা ইতিবাচক। সব মিলিয়ে সংকটের প্রথম ধাপ সরকার ভালোভাবে পার করেছে। আগামী দিনের পরিকল্পনা সঠিক বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক সংকটও আসবে না। তবে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। এ অবস্থা ধরে রাখতে আরও তৎপর থাকতে হবে। আগামী দিনে চালের আপৎকালীন নিরাপত্তার জন্য আরও ১০ লাখ টন চাল আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
করোনাকালীন বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। এ কারণে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের দাম বাড়েনি। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এই সময়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম চড়া ছিল। কিন্তু গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন সংকটময় মুহূর্তে অনেক পণ্যের দাম কম রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল ও লবণ ইত্যাদি। তবে চাল ও মসুর ডালের দাম কিছুটা বেশি।
করোনা সংকটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপর থাকার জন্য সংশ্নিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশে আমদানি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে লকডাউনের মধ্যেও বিশেষ ব্যবস্থায় সব কার্যক্রম সচল রেখেছে।
বন্দরে পণ্য খালাস অব্যাহত ছিল। এতে আমদানি পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি হয়নি। শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয় স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে পণ্য নিশ্চিত করতে টিসিবির মাধ্যমে দেশজুড়ে খোলা ট্রাকে কম দামে পণ্য বিক্রি করা হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে খোলা ট্রাকে ১০ টাকা কেজি চাল ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে বিক্রি করা হয়। এই দুই সংস্থার কার্যক্রমে চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া বাজারে পণ্যের দাম তদারকিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তৎপর রয়েছে।
এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেন,
অন্যান্য বছরের চেয়েও এবার করোনা সংকটের মধ্যে রমজান মাসে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য, শিল্প, খাদ্য ও কৃষিসহ অন্য সব মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে জোরদার পদক্ষেপ নিয়েছে। টিসিবি ও খাদ্য অধিদপ্তর সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে পণ্য বিক্রি করায় বাজার স্বাভাবিক রাখা অনেকটা সহজ হয়। খাদ্যপণ্য আমদানি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত সহযোগিতা করেছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও দুর্যোগের এই সময়ে বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানি উৎপাদন ব্যয়ে সাধারণ মানুষের জন্য পণ্য বিক্রি করেছে। এতে সংকটকালীন খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। তিনি বলেন, আগামী দিনেও সরকার ও ব্যবসায়ীরা যৌথভাবে এই সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, খোলা বাজারে বিক্রি ও ত্রাণ বিতরণের পরে এখনও প্রায় ১০ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সরকারের চাল সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। এর পরেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি চাল আমদানির পরিকল্পনা আছে।