এলোমেলো হয়ে গেছে দেশের পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা। সংখ্যায় তারা প্রায় ১৩ লাখ। গত ১ এপ্রিল থেকে তাদের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষা দিতে না পারায় এই বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর মানসিক অবস্থা এলোমেলো হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ ও বিরক্তও তারা।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা মার্চেই স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে টানা চার মাস বসে আছেন পরীক্ষার্থীরা। এ পরীক্ষার নতুন রুটিন করা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা যাচ্ছে না। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, কলেজগুলো খুলে দেওয়া হলেই এই রুটিন প্রকাশ করা হবে।
পরীক্ষার প্রস্তুতি ও পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ও অনিশ্চয়তা তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শাহরীমা শাম্মীর মা শাহমিকা শাহরিন অনামিকা বলেন, ‘মেয়ের জন্য পরীক্ষার আগে বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ে আলাদা শিক্ষক রেখেছিলাম।
গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সব বিষয়ে পুরো প্রস্তুতি নেওয়ার পর পরীক্ষার আগমুহূর্তে কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গেল। এরপরও লেখাপড়ায় ওর মনঃসংযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি কয়েক দফায় বাড়ানোর পর ও পড়াশোনাই ছেড়ে দিয়েছে। পড়তে বসতে বললেও রেগে যায়। সারাদিন মোবাইল ফোনে গেমস খেলে।
তবে কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগে এইচএসসি পরীক্ষা-২০২০ হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ সিদ্ধান্তে দৃঢ় অবস্থানে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘করোনার মহামারি চলার সময় এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া এককথায় অসম্ভব। লাখ লাখ শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মচারীরা দেশব্যাপী পরীক্ষার সময় সংগত কারণেই একত্র হবেন, ভিড় জমাবেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও বিপুল সদস্য মোতায়েন করতে হবে।
এ ধরনের বিপুল লোকসমাগমে আরও বেশি লোকের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগে এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। আমাদের সন্তানদের আমরা নূ্যনতম ঝুঁকির মধ্যেও ফেলতে পারব না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তবে সব প্রস্তুতি আছে- কলেজগুলো খুলে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই পরীক্ষা নেওয়া যাবে।
শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা আয়োজনের সময়সীমা কমিয়ে আনা হবে। দেড় মাসের বদলে এটি এক মাসের মধ্যে শেষ করা হতে পারে। এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি থেকে এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মোকবুল হোসেন বলেন, আগে যে পরীক্ষাগুলোর মাঝে দুই থেকে তিন দিন বিরতি ছিল, তা কমিয়ে এক দিন করে বিরতি দেওয়া হতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এর সম্ভাবনা খুবই কম। এই শিক্ষার্থীরা তো এরই মধ্যে তাদের সিলেবাস শেষ করেছে। তাহলে বিষয় কমিয়ে লাভ কী? মন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে যদি কখনও এমন পরিস্থিতি দেখা দেয়, কোনোভাবেই এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না, আরেকটি বছর চলে এসেছে বা সময়ে একেবারেই কুলাচ্ছে না, তখন দূরবর্তী একটি সম্ভাবনা হিসেবে বিষয় কমানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
শিক্ষা বোর্ডগুলো সাধারণত একটি পাবলিক পরীক্ষার কাজ শেষ করে আরেকটি পরীক্ষা নেয়। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলে এর ১৫ দিনের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু করতে হবে। নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে আবার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা শুরুর পূর্বনির্ধারিত সূচি রয়েছে। এতে সব পরীক্ষার মধ্যে জট লেগে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। না হলে প্রাদুর্ভাবের পর পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হবে।
আগামী এক মাসের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে পাঠদান কার্যক্রম ছয় মাস পিছিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। আর এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সিলেবাস, ক্লাস ও পরীক্ষা কমিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে নতুনভাবে পরিকল্পনা করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
সিলেবাস কাটছাঁট এবং পরীক্ষা কমিয়ে আনার বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, আগামী মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অবশ্যই সিলেবাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হবে, কিছু ক্লাস-পরীক্ষা কমিয়ে আনা হতে পারে।