করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে আতঙ্ক ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে গেল ঈদুল ফিতরের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। সেই তুলনায় এবার ঈদুল আজহায় মানুষ কিছুটা হলেও উদ্দীপনা নিয়ে ঝুঁকছে ঈদের দিকে। তবে নেই ঈদের নিরঙ্কুশ আনন্দঘন পরিবেশ। এমনকি কোরবানির ধর্মীয় আচার পালনেও ঘটছে বিঘ্ন। করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যার দুর্যোগ। সব মিলিয়ে আগামীকাল দেশের মুসলমানরা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এক ঈদ উদ্যাপন করতে যাচ্ছেন।
জীবনযাত্রার অপরিহার্য হয়ে ওঠা স্বাস্থ্যবিধিকে রক্ষাকবচ ধরেই সরকার উন্মুক্ত রেখেছে ঈদ উদ্যাপনের যাবতীয় আয়োজন। তবে ঘরে-বাইরে সেই রক্ষাকবচে পাত্তা নেই মানুষের। যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত থাকায় বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করেই ঢাকাসহ শহরগুলো ছেড়ে অনেকে ছুটছে গ্রামের বাড়িতে। কয়েক দিন বাস-ট্রেন-লঞ্চে ভিড় তেমন না থাকলেও বুধবার বিকেল থেকে পাল্টে যায় চিত্র। বিশেষ করে নৌপথে বেড়ে যায় ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে স্বাভাবিক সময়ের ঈদ যাত্রার মতোই লাখো মানুষের ঢল বয়ে যায় ঢাকার সদরঘাট অভিমুখে। সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে যাত্রী বোঝাই করে গন্তব্যে রওনা দেয় একেকটি লঞ্চ।
ভিড় আগের মতোই ঠাসাঠাসি পর্যায়ে দেখা গেছে। অন্যদিকে কয়েক দিন কোরবানির পশুর হাটে ভিড় না থাকলেও গতকাল যথারীতি ভিড়ভাট্টায় জমে ওঠে প্রতিটি হাটই। ক্রেতা-বিক্রেতায় একাকার সবখানে। পাশাপাশি নামিদামি শপিং মল বা আলাদা বিপণিবিতানগুলোতেও বেড়েছে অবাধ ভিড়। পথে জনচলাচলেও নেই সীমিত কোনো দৃশ্য। সামাজিক দূরত্ব পালনের কোনো দৃশ্যমান পরিবেশ নেই, অনেকে মাস্ক ব্যবহারেও নেই। রীতিমতো স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিতভাবেই চলছে ঈদ উদ্যাপনের সার্বিক প্রস্তুতি।
ঈদের পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবারের ঈদকে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে বড় চ্যালেঞ্জের ঈদ উদ্যাপন’ বলে অভিহিত করেছেন। গতকাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক ঈদ ঘিরে চলাচল এবং হাট-বাজারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ঈদের পর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ধর্মীয় পর্যায় থেকে এবারের ঈদের নামাজ নিয়েও দেওয়া হয়েছে আলাদা নির্দেশনা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ঈদগাহ বা খোলা স্থানের পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ ১৩টি শর্তে মসজিদগুলোতে ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
দেশে গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হিসাবে শনাক্ত হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে তিন হাজার ৮৩ জন এবং সুস্থ হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৯৬০ জন। বাকিরা এখনো করোনা আক্রান্ত হিসেবেই আছে, যাদের মধ্যে হাসপাতালে আছে চার হাজারের বেশি মানুষ। অন্য আক্রান্তরা বাসায় অবস্থান করছে। আগের মতো আতঙ্ক না থাকলেও তাদের ঘরে ঈদ উদ্যাপনের আয়োজন না থাকাই স্বাভাবিক।
বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের কাছে এবারের ঈদ আনন্দ আরো ফিকে হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে, কেউ বা আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের কাদাপানিতে। সেখানে তারা ঝুপড়ি বানিয়ে পার করছে দুর্যোগের সময়। আবার অনেকে বানের পানিতে হাবুডুবু খেয়েও নিজ নিজ ঘরে আটকে আছে। এসব মানুষের কাছে ঈদের আনন্দ বলতে কিছুই নেই। তারা এখন ত্রাণের অপেক্ষায় থাকে সব সময়।
দেশে এখন পর্যন্ত বন্যাকবলিত জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৫০টি এবং ইউনিয়নের সংখ্যা ৯৩৬টি। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজার ২৬৬টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৩ জন।
বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এক হাজার ৫৪৮টি। আশ্রয় নেওয়াদের সংখ্যা ৭৩ হাজার ১৭৩ জন। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে ৮৯৩টি এবং বর্তমানে চালু আছে ৩৭২টি। মানুষের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত গবাদি পশুর সংখ্যা ৭৭ হাজার ৩০১টি।