অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে গুলিতে হত্যা করেছে পুলিশের এসআই লিয়াকত আলী। টেলিফোনে লিয়াকতকে গুলি করার হুকুম দিয়েছেন তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এ বিষয়টি তদন্তসহ সর্বতোভাবে এখন স্পষ্ট।
এখনও অনুদঘাটিত রয়েছে কেন ওসি প্রদীপ গুলি করার হুকুম দিলেন। আর এসআই লিয়াকত আলী কেনই বা সেই অবৈধ নির্দেশ পালন করলেন। গুলি করে হত্যা করলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে।
ঘটনার সঙ্গে জেলা এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
মঙ্গলবার এ মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন আরও ৩ জন। এরা এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন) সদস্য এবং ঘটনার সময় হত্যার স্পট অর্থাৎ শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী।
৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার প্রাইভেটকার আটকিয়ে এবং সেখান থেকে হাত তুলে নামার নির্দেশ দিয়ে একেবারে দ্রুততম সময়ে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই লিয়াকত আলী প্রথমে একটি ও পরে আরও তিনটি গুলি করে তাকে হত্যা করে।
দশ মিনিট পর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেন এবং প্রায় মৃত সিনহাকে পর পর কয়েকটি লাথি মারেন। এরপর সিনহাকে একটি মিনি ভ্যানে তুলে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যা নেপথ্যের কাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও অনুদঘাটিত। সরাসরি গুলি করে সিনহাকে হত্যাকারী এসআই লিয়াকতই বলতে পারবেন কেন তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।
নেপথ্যে কোন পরিকল্পনা ছিল কিনা। নাকি এটা তাৎক্ষণিক কোন পরিস্থিতির ফল। নাকি ওসি প্রদীপ কুমারের নির্দেশনায় তিনি সিনহাকে হত্যা করেছেন। এর সবই বলতে পারবেন একমাত্র এসআই লিয়াকত।
হত্যার যিনি নায়ক সেই এসআই লিয়াকত আলী, হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এ সংক্রান্তে পুলিশী মামলার বাদী এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে অবশেষে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব রিমান্ড হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হয়েছে মঙ্গলবার থেকে।
চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে সিনহাকে হত্যা করা হয় সেই চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন) এর ৩ সদস্যকে সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের পর মঙ্গলবার গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। র্যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ তিনজনকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়া বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কক্সবাজারের বর্তমান এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন, গ্রেফতারকৃত ওসি প্রদীপ কুমারসহ ৮ জনের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে এবং তা কার্যকর হয়েছে।
আরও ৩ জন গ্রেফতার হওয়ায় এ হত্যা মামলায় আসামির সংখ্যা দাঁড়াল ১৫।
৪ আগস্ট কক্সবাজার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস মামলার আবেদন জানালে আদালত টেকনাফ থানাকে তা এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশনা প্রদান করেন। ওইদিন রাতেই থানায় মামলা নথিভুক্ত হয়।
এ মামলায় ৭ পুলিশকে আসামি করা হয়। এরা হলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা।
দুই আসামির কোন খবর এখনও তদন্ত সংস্থা পায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুলিশে এ ধরনের কোন সদস্য নেই বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর গত ১১ আগস্ট ঘটনা নিয়ে পুলিশী মামলার ৩ সাক্ষী বাহারছড়ার মারিসবুনিয়ার অধিবাসী নুরুল আমিন, নাজিম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছকে র্যাব গ্রেফতার করে। এর ফলে এ মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২।
সিনহা হত্যা মামলায় র্যাব মঙ্গলবার এপিবিএনের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করার পর রিমান্ড প্রার্থনা করলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের সময় মঞ্জুর হয়। এর আগে এপিবিএনের এ তিন সদস্যকে সোমবার রাতে র্যাব কার্যালয়ে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত এ ৩ সদস্য হলেনচেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী সহকারী উপ-পরিদর্শক শাহজাহান, কনস্টেবল রাজিব ও আবদুল্লাহ।
ঘটনাকালীন শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। এপিবিএনের এ তিন সদস্যকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনার সময় চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী এপিবিএনের এ তিন সদস্যকে সোমবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ধারণা জন্মেছে হত্যা সঙ্গে এরা পরোক্ষভাবে জড়িত।
ঘটনার সার্বিক দিকসমূহ বিশ্লেষণ করে এদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে মঙ্গলবার আলাপকালে জানিয়েছেন, তদন্ত কর্মকর্তা হত্যা সার্বিক দিক গুছিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছেন।
৯ দিনের মাথায় তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়। নতুন দায়িত্ব পান এএসপি খাইরুল ইসলাম। তাকে র্যাব-৭ থেকে বদলি করে সরাসরি সিনহা হত্যার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। গত ১৩ আগস্ট রাতেই এএসপি খাইরুল ইসলাম মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন এবং পরদিন ১৪ আগস্ট ৪ পুলিশসহ ৭ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় নতুন করে আরও ৩ জন গ্রেফতার হয়েছে এ মামলায়।
তিনজনই এপিবিএন সদস্য এবং ওইদিন শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত ছিলেন। মঙ্গলবার গ্রেফতারের পর তাদের আদালতে সোপর্দ করে র্যাবের পক্ষে দশ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম (টেকনাফ-৩) তামান্না ফারার আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
প্রধান তিন আসামি কিলার এসআই লিয়াকত আলী, হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও হত্যা ঘটনা নিয়ে পুলিশের দায়েরকৃত কথিত মামলার বাদী টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে র্যাব। এ তিনজনকে আদালত আগেই ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত এ হত্যাকা-ের মামলায় র্যাব ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।
মঙ্গলবার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রথমবারের মতো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিনহার কিলার এসআই লিয়াকত আলী, ঘটনার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও ঘটনা নিয়ে পুলিশী মামলার বাদী এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে। ইতোপূর্বে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
এ তিনজনের মধ্যে কিলার এসআই লিয়াকত আলী ও হুকুমদাতা ওসি প্রদীপ কুমার দাশ থেকেই হত্যাকা-ের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। অবশিষ্ট আসামিদের অধিকাংশ পরোক্ষভাবে এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘটনা নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য মিলেছে।
মৎস্য ও কমিশন ব্যবসার ভুয়া ব্যানারে প্রদীপ দম্পতি গড়ে তুলেছেন বিপুল অঙ্কের অর্থের বিত্ত ভৈবব। অবৈধ অর্থ অর্জনের মূল হোতা হলেও প্রদীর স্ত্রী চুমকির নামেই বিপুল অঙ্কের অর্থ ও সম্পদ গড়েছেন। এক্ষেত্রে প্রদীপের চাইতে স্ত্রীই বেশি সম্পদশালী হিসেবে তথ্য বেরিয়ে এসেছে।