দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটি ডাকনাম দিত, এমনকি শত্রুপক্ষের যুদ্ধাস্ত্রেরও। জার্মান মেশিনগান-৪২ সংক্ষেপে এমজি-৪২ কে আমেরিকান সৈন্যরা ডাকতো ‘Hitler’s Buzz Saw’ এবং সোভিয়েত রেড আর্মির সৈন্যরা ডাকতো ‘The Linoleum ripper’ নামে। কেননা এটি করাতের মতই শত্রুপক্ষের সৈন্যদেরকে নিমিষেই শেষ করে দিত। বহু সামরিক ইতিহাসবিদ এমজি-৪২ কে এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে সেরা ‘জেনারেল পারপাস মেশিনগান’ বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন জার্মান সেনাবাহিনীর সার্ভিসে ছিল নির্ভরযোগ্য একটি মেশিনগান এমজি-৩৪। কিন্তু এমজি-৩৪ ছিল একটি ব্যয়বহুল অস্ত্র। কেননা এর উৎপাদন ছিল সময়সাপেক্ষ এবং তুলনামূলক কঠিন।
যুদ্ধ শুরুর পর জার্মান হাইকমান্ড ফ্রন্ট-লাইনে এমন অধিক মেশিনগানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে যেগুলো হবে এমজি-৩৪ এর মত ক্ষিপ্র কিন্তু তুলনামূলক সস্তা এবং যেগুলোর উৎপাদনও হবে দ্রুততর। অবশেষে জার্মান অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি মাউজার এরকম একটি মেশিনগান ডিজাইন করতে সক্ষম হয় যেটি সার্ভিসে আসে ১৯৪২ সালে। এজন্য এর নাম দেওয়া হয় এমজি-৪২। অতি উচ্চ হারে গুলি ছোঁড়ার সক্ষমতা (মিনিটে ১৬০০ রাউন্ড), স্থায়িত্ব, নির্ভরযোগ্যতা, অধিক কার্যকরী রেঞ্জের কারণে (২০০-২০০০ মিটার) এবং ব্যবহার সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্য-পূর্ণ হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি এমজি-৪২ একটি অতি-আগ্রাসী, দানবীয় অস্ত্রে পরিণত হয়।
এই মেশিনগানের শব্দ মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের অন্তরে রীতিমত কাঁপন ধরিয়ে দিত। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, আতঙ্কিত মার্কিন সেনাদের মাঝে এই অস্ত্রের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে রোধ করার জন্য মার্কিন সেনাবাহিনী একটি প্রশিক্ষণ ফিল্ম তৈরি করতে বাধ্য হয়।
এমজি-৪২ ছিল জার্মান পদাতিকদের হাতে মারাত্মক এবং কার্যকর এক অস্ত্র। যেখানে সাধারণত পদাতিক বাহিনীতে মেশিনগান সৈন্যদের আক্রমণের সহায়তায় ব্যবহৃত হয় সেখানে জার্মানদের ট্যাকটিক্স ছিল এর উল্টো। এর ধ্বংসাত্মক ভূমিকার কারণে আক্রমণের মধ্যভাগে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় মেশিনগানকে রেখে পুরো পদাতিক বাহিনীকেই এর সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করত নাৎসিরা। উচ্চহারে গুলি ছোঁড়ার সক্ষমতার কারণে দেখা যেত, মাত্র একটি মেশিনগানই শত্রুপক্ষের শত শত সৈন্যকে মুহূর্তেই কচুকাটা করে ফেলেছে!
১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্য চার লক্ষ ইউনিটেরও অধিক এমজি-৪২ উৎপাদিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আলজেরীয় যুদ্ধ, যুগোস্লাভীয় যুদ্ধ, প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ, পর্তুগিজ যুদ্ধসহ প্রভৃতি যুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে জার্মানি এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩০ এরও অধিক দেশের সেনাবাহিনীতে এমজি-৪২ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।