নিজের দেশকে, দেশের প্রকৃতিকে অনেক বেশি ভালোবাসি। অবাক হই দেশের বিভিন্ন রত্নভাণ্ডার দেখে। তবে পাশের দেশ ভারতের একটা দিক আমায় বেশ অবাক করে, একই দেশে একই সময়ে হরেক রকমের আবহাওয়া, একটি আরেকটির সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতে উত্তরের দিকে গেলে যেখানে শুভ্র বরফ পাওয়া যাবে, সেখানে যত দক্ষিণের দিকে যাওয়া হয় গরমের উত্তাপ বাড়তে থাকে। একই সময়ে পাহাড়ের উঁচুতে বরফ দেখা যায়, আবার সেই সময়েই দেখা মেলে ধূ ধূ মরুভুমির বুকে উটের পদচারণার। হিমাচলে গেলেও মরুভূমি দেখা হয়নি এখনো। বলছি ভারতের রাজস্থানের কথা।
দিল্লি থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দূরের প্রদেশ রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। জয়পুর ছাড়াও আরো আছে উদয়পুর, জয়সালমির, বিকানের, আজমির, রানাকপুর, মান্ডায়া সহ আরো ৪১টি শহর। রাজস্থানের উন্নত শহরগুলো জয়পুর, উদয়পুর, আজমির। রাজস্থান পুরোটা এক্সপ্লোর করতে মোটামুটি মাসখানেক লেগে যাবে। ৫-৬ দিনের একটা ট্রিপ দিতে চাইলে রাজস্থানের কেন্দ্রবিন্দু পিংক সিটি নামে খ্যাত জয়পুরের বিকল্প নেই। সাথে দিল্লিটাও ঘুরে নেয়া যাবে।
প্রশ্ন হলো যাবেন কীভাবে? বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে কোলকাতা যেতে হবে। এতে করে যাত্রা পথে আরেকটি শহর ঘোরা হয়ে যাবে। অথবা সরাসরি ঢাকা থেকে দিল্লি/ জয়পুর যাওয়া যাবে প্লেনে চড়ে। যদি আকাশযাত্রা করতেই চান ছোট্ট একটা বুদ্ধি দিই, কোলকাতা গিয়ে ডোমেস্টিক ফ্লাইটের টিকেট কাটলে খরচ ২-৩ হাজার টাকা কম পড়বে যদি প্লেনের টিকেট ১-২ মাস আগে কাটা হয়।
বাজেট ট্রাভেলারদের ট্রেন ছাড়া গতি নেই। হাওড়া থেকে দিল্লির পুরভা এক্সপ্রেস, রাজধানী এক্সপ্রেস, কালকা মেইল ইত্যাদি ছেড়ে যায়। রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি পৌঁছাতে সময় কম লাগলেও ভাড়া প্রায় উড়োজাহাজের কাছাকাছি, কারণ এই ট্রেনে কোনো স্লিপার বগি নেই, সব এসি। আর ট্রেন চলবে ১৩০-১৫০ কি.মি./ঘণ্টা বেগে। পুরভা এক্সপ্রেস আর কালকাতে স্লিপার ক্লাস আছে, ভাড়াও একই রকম, ৬০০ রুপি। পুরভা এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে ছেড়ে যায় সকাল ৮:০৫ মিনিটে আর কালকা মেইল সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে। পুরভা এক্সপ্রেস নিউ দিল্লি স্টেশনে আর কালকা মেইল ওল্ড দিল্লি স্টেশনে দাঁড়ায়।
দিল্লিতে নেমে আইএসবিটি কাশ্মীরি গেটের কাছে কোনো হোটেল নেয়া ভালো। পরদিন কাশ্মীরি গেট থেকেই তাহলে ট্যুরিস্ট বাস পাওয়া যাবে। সকাল ৮টায় ট্যুরিস্ট বাস কাশ্মীরি গেট থেকে ছাড়ে, কভার করে দিল্লির সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো। গাড়ি ভাড়া না করে ট্যুরিস্ট বাসে চড়ার সুবিধা দুটো, একে তো ভাড়া মাত্র ৩৫০ রুপি, তার উপর একসাথে অনেক দেশের লোক যখন একটি বাসে ওঠে তখন হরেক ভাষার কিচিরমিচির দিল্লি ভ্রমণকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।আর গাইড তো সাথে থাকছেনই।
কোন জায়াগটা কী তাৎপর্য বহন করে তা বর্ণনা করার জন্য। দিল্লি ভ্রমণ একদিনেই সম্ভব। পরদিন দিল্লি থেকে বাসে জয়পুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিন। হোটেলে বললে কমিশন রেখে ওরাই বাসের টিকেট কেটে দেবে, আসল ভাড়া ৪০০-৪৫০ রুপি। দিল্লি থেকে জয়পুরের দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিমির মতো, যেতে সময় লাগে ৪.৩০-৫ ঘন্টা।
দূর্গে ঘেরা জয়পুরে ঘুরে দেখার মতো আছে অনেক জায়গা, আছে হাজার বছর পুরনো ঐতিহ্য। স্থাপত্যকলার পূর্ণ জ্ঞান কাজে লাগানো হয়েছে এখানকার প্রত্যেকটা মহলে। জয়পুরের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর নাম বলতে চাইলে সবার আগে আসবে হাওয়া মহল, আমির ফোর্ট, জল মহল, সিটি প্যালেস, জন্তর মন্তর, জয়গড় ফোর্টের কথা।
হাওয়া মহল
১৭৯৯ সালে রাজা সাওয়াই প্রতাপ সিং ক্ষেত্রি মহলের স্থাপত্যকলায় মুগ্ধ হয়ে লাল-গোলাপি পাথরের হাওয়া মহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, নকশার দায়িত্ব পড়ে লাল চন্দ উস্তাদের ঘাড়ে। গুণে গুণে ৯৫৩টি জানালা আছে এই মহলে। এই মহলটা বানানো হয়েছিল মূলত তৎকালিন রাজকীয় নারীদের রাস্তায় বিভিন্ন উৎসব উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সেই ছোট ছোট জানালা দিয়ে তাঁরা উপভোগ করতেন বিভিন্ন পূজা-পার্বণ আর চমৎকার সব আনন্দযাত্রা, একই সাথে বাইরে থেকে কেউ তাঁদের দেখতে পেত না। এটাই ছিল হাওয়া মহলের বিশেষত্ব।
হাওয়া মহলের ঠিক পেছনেই বিশাল জায়গা নিয়ে জয়পুরের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে এই সিটি প্যালেস। দক্ষ নকশাবিদ দ্বারা তৈরি এই প্রাসাদে একই সাথে রাজপুত, মোঘল, ইউরোপিয়ান আর জয়পুরের রাজকীয় পরিবারের ধাঁচ দেওয়া হয়েছে। সিটি প্যালেসের মূল অংশ দুটো, চন্দ্রমহল আর মোবারক মহল। এই প্রাসাদের একটা অংশ এখন রাজা সাওয়াই দ্বিতীয় মান সিং এর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সে সময়কার দুর্লভ ধর্মীয় আর শৈল্পিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আজকের এই জাদুঘর।
আমীর ফোর্ট
জয়পুর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে ৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জায়গা আমীর। রাজা প্রথম মান সিং এই আমীরে গড়ে তোলেন ৪ তলার প্রকাণ্ড এক প্রাসাদ যার নাম “আমীর ফোর্ট” বা “আমীর প্যালেস”। মাওতা হ্রদ দ্বারা বেষ্টিত এই প্রাসাদের প্রতি তলায় বিচারকার্যের বারান্দা সহ রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারুকার্য। প্রথম তলায় সাধারণদের প্রবেশাধিকার ছিল, দ্বিতীয় তলায় বিশেষ ব্যাক্তিদের, ৩য় তলায় আছে শিষ মহল বা কাঁচ মহল আর চতুর্থ তলায় মানুষের তৈরী এমন এক ব্যবস্থা আছে যাতে হ্রদের বাতাস সরাসরি সেখানে পৌছায়, জায়গাটির নাম দেয়া হয়েছিল “সুখ নিবাস”। আমীর ফোর্ট এর উপর থেকে পুরো জয়পুরের যে দৃশ্য দেখা যায় তা সহজে ভোলা যায় না। হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া যায়
জল মহল
জয়পুরের প্রাণকেন্দ্র মন সাগর লেকের ঠিক মাঝখানে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ তলার দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ জল মহল। প্রাচীন রাজাদের তৈরী করে যাওয়া এই জল মহলকে রাজা দ্বিতীয় জয় সিংপুনরায় উদ্ধার করে সংস্কার করেন। মন সাগর লেক যখন পূর্ণ থাকে তখন এই পাঁচ তলা ভবনের চার তলাই থাকে পানির নিচে, পঞ্চম তলা খালি মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন জল মহল। সম্প্রতি পানির কারণে কাঠামোগত দিক দিয়ে জল মহল নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় ভারত সরকার এর সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে।