বিডিআরের ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামায়াত ও ওয়ান ইলেভেন সৃষ্টিকারীদের সম্পৃক্ত থাকার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা বলার ভালো একটা আর্ট আছে। সরকারে থেকে আমরা এমন একটা ঘটনা ঘটাবো, তা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। যারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি, তারাই তখন তাদের পেছনে ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর তাদের সঙ্গে ছিল ওয়ান ইলেভেন যারা সৃষ্টি করেছিল তারা। আওয়ামী লীগ মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসায় সবকিছুকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনায় তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। একদিন না একদিন সত্যটা বের হবে।
রবিবার একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের প্রথম দিনে শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে তিনি আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ওই ঘটনা কেন ঘটলো, কীভাবে ঘটেছে সেই ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আমি মনে করি এটি বের হবে।
যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে, নকশা না মেনে যেখানে সেখানে ইমারত গড়তে এবং বিদ্যুৎ সরকারের সক্ষমতা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকার পরও মসজিদে অপরিকল্পিত এয়ারকন্ডিশনার বসানো হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যে বাড়বে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর ওই আলোচনা হয়।
এছাড়াও সংসদের পক্ষ থেকে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত, সেক্টর কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কর্ণেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান, প্রতিরক্ষা সচিব আব্দুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, আইন ও বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক দুলাল, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী কামাল লোহানী, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খানসহ প্রায়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও রাজনীতিবিদের নামে শোক প্রকাশ করা হয়।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও অংশ নেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আওয়ামী লীগের শাজাহান খান, অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার, শামসুল আলম দুদু, বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও বিএনপির মো. হারুনুর রশীদ।
আলোচনা শেষে শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। এরপর প্রয়াতদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরাবতা পালন শেষে মোনাজাত করা হয়।
২০০৯ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এ ঘটনার পেছনে কারা ছিল? আমরা তো কেবল সরকার গঠন করেছি। এটা কোনোদিনই যুক্তিযুক্ত না, যে আমরা সরকার গঠন করেই এমন একটা ঘটনা ঘটাবো, যাতে দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। কাজেই যারা তখন ক্ষমতায় আসতে পারেনি তারাই তাদের পেছনে ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই।
বিডিআরের ঘটনার সময় সাহারা খাতুনের সাহসী ভূমিকা দেখেছি। সাহারা আপা ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গেছেন। রাতের বেলা সেখানে গিয়ে বিডিআর সদস্যদের আর্মড সারেন্ডার করিয়েছেন। অনেক আর্মি অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেছেন।
এজন্য তাঁর জীবনের ওপরও হুমকি এসেছিল। তাঁর ওপর ওরা হামলা করতে গিয়েছিল। এরকম অবস্থায় সাহারা খাতুন দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছিলেন। কোনো সাধারণ মানুষ এই সাহস করতে পারতো না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সততার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ কঠিন দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
১/১১ যারা সৃষ্টি করেছিল- যাদের ধারণা ছিল নির্বাচনে একটা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে। কিন্তু যখন দেখল আওয়ামী লীগ মেজরিটি নিয়ে চলে এলো- তখন সবকিছুকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা যাদের ভেতরে ছিল তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। একদিন না একদিন এই সত্যটা বের হবে।
সংসদ নেতা বলেন, ২০০৭ সালে যখন আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। বিএনপি আমার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দিয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক আসার পর আরো ৫/৬টি মামলা দেওয়া হয়। তাদের প্রচেষ্টা ছিল মামলাগুলি দ্রুত চালিয়ে আমাকে শাস্তি দেবে। এই মামলার সময় সাহারা আপা সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতেন। মামলা পরিচালনা করতে আমাদের আইনজীবীরা এলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করত, গ্রেপ্তার করত। তাদের ছাড়িয়ে আনতে ছুটে যেতেন সাহারা আপা।
ইসরাফিল আলমকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত অল্প সময়ে সে চলে যাবে বুঝতে পারি নাই। তার করোনা হওয়ার পর ভালো হয়েছিল।
তার কিডনির সমস্যা ছিল। কিন্তু সে কিছু মানেনি। যখন একটু সুস্থ হলো চলে গেল এলাকায়। এভাবে করোনার সময় আমরা আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মীকে হারিয়েছি। করোনার সময়ে তারা ঘরে ঘরে মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছে দিয়েছে। বন্যার সময় রিলিফ পৌঁছাতে গেছে। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে, মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়েই কিন্তু তাঁরা জীবন দিয়েছেন।
অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা অবশ্যই বের হবে : নারায়ণগঞ্জে একটি মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে বিএনপির হারুনুর রশীদের কিছু দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে, নকশা না মেনে যেখানে সেখানে ইমারত গড়লে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকার পরও মসজিদে মসজিদে অপরিকল্পিতভাবে এয়ারকন্ডিশনার বসানো হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে, মসজিদে যে বিস্ফোরণটা ঘটল, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এই ঘটনাটা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটল, সেটার ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশের পাশে ছিলেন প্রণব মুখার্জী : প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সদ্যপ্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যয়ের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, তাঁর মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করবে।
একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন। প্রনব মুখার্জীর মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তিনি আরো বলেন, ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন।
সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন আমাদের পাশে ছিলেন, ১৯৭৫-এ আমাদের পাশে ছিলেন এবং এর পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আমি বন্দি থাকাকালেও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নিয়ে আমার ওপর দোষারোপ চাপালো তখনও তিনি সেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেছেন। সব সময় তিনি বাংলাদেশের কল্যাণে চিন্তা করতেন।
দুই সেক্টর কমান্ডারসহ প্রয়াতদের কথা স্মরণ করতে গিয়ে সংসদ নেতা বলেন, একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন। মৃত্যু অবধারিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মৃত্যু যে ক্ষত চিহ্নটা রেখে যায় সেটাই খুব কষ্টকর। সত্যিই এটা দুঃখজনক যে আমাদের একের পর এক অনেক সংসদ সদস্যকে হারাচ্ছি। আর প্রতিবারই শোক প্রস্তাব গ্রহণ করতে হয়েছে।
করোনাভাইরাসের পর এটি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের সি আর দত্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার। যখন জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ দেন এবং ২৫ মার্চ যখন গণহত্যা শুরু হয়, যে মুহূর্তে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- তখনই আমাদের সেনা অফিসাররা সাহসী ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঠিক সেইভাবে আবু ওসমান চৌধুরী তিনি চুয়াডাঙ্গা তখন কর্মরত ছিলেন।
তিনিও সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ওসমান চৌধুরী আর সি আর দত্ত তাঁরাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেই সময় যে সাহসী ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছিলেন, সেজন্য আজকে আমরা বিজয়ের জাতি।