স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারি ও বর্বরতার ব্যাপারে বাংলাদেশ সোচ্চার।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন গতকাল শনিবার দুপুরে বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর খুব একটা চাপ আসবে বলে তিনি মনে করেন না। তবে পরোক্ষ চাপ তো সব সময় আছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য না করার মাধ্যমে আমরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউওটিও) শর্ত ভঙ্গ করছি, এমন অভিযোগও একবার উঠেছিল।
পরে তা সামাল দেওয়া হয়েছে। অতীতে ইসরায়েলি কাউকে প্লেনে না নেওয়ার নীতির কারণে কুয়েতের নিউ ইয়র্ক-কুয়েত ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের ছোট ছোট সমস্যা সৃষ্টি হয়। কারণ ইসরায়েলের মুরব্বিরা খুব ক্ষমতাশালী।
আমার মনে হয় না, এই মুহূর্তে আমাদের ওপর বড় কোনো চাপ সৃষ্টি হবে। কারণ সৌদি আরব এই মুহূর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না। যদিও সৌদি আরব ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এর পরও আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব তা করবে না।
সৌদি আরব যখন ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করবে তখন বাংলাদেশের ওপর চাপ আসার ভালোই আশঙ্কা আছে। তখন তো আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কোনো কারণও থাকবে না।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে; কিন্তু অন্যদের নিরুৎসাহিত করে—এমন দ্বিমুখী অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের সব সময় এই অবস্থান ছিল। তাদের যুক্তি হলো, ইসরায়েল তাদের প্রতিবেশী। তাদের অনেক সমস্যা আছে।
যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া জর্দানের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। বিশেষ করে মিসর সম্পর্ক স্থাপন করার পরে। জর্দানকে পানি কিনতে হয় ইসরায়েল থেকে।
তিনি বলেন, যাদের সীমান্ত আছে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ আছে তাদের সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু অন্যরা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখত। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তো বহুদিন ধরে তাদের (ইসরায়েল) অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক আছে।
ওমানের সঙ্গে আছে। সৌদি আরবের সঙ্গেও প্রচুর সম্পর্ক তাদের। কিন্তু তারা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না বা সামনে আনে না। যত দিন সৌদি আরব সামনের দিকে সম্পর্ক না নিয়ে আসছে তত দিন পর্যন্ত আমাদের ওপর চাপটা খুব বেশি থাকবে না।
আল-আকসা, জেরুজালেম, ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের জোরালো অনুভূতি আছে। তবে বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিরা হচ্ছে আরব। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের সম্ভাব্য সব উপায়ে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে আসছে।
এখন আরবরাই যদি ফিলিস্তিনিদের সমস্যা সমাধান না করে ইসরায়েলিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে যায় তবে অনেকের কাছেই হতাশার কারণ হবে। অনেকেই তখন নিজেদের স্বার্থ আরো বেশি করে দেখতে উৎসাহিত হবে।
ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন বা বিদ্যমান অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি আঁচ করা যাচ্ছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে। বিশেষ করে সরকারি বিবৃতি ও সফর বিনিময় থেকে তা স্পষ্ট। গত ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েল-বাহরাইন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা এসেছে গত শুক্রবার রাতে।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চুক্তি বা সমঝোতা করা আরবদেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন চতুর্থ। এর আগে মিসর ও জর্দানও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও এর অধিকার প্রতিষ্ঠার আগেই আরবদেশগুলো যেভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা শুরু করেছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। এর কমবেশি প্রভাব পড়তে পারে অন্য অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর ওপরও।
উল্লেখ্য, এ মাসের শুরুতেই সৌদি আরব তার আকাশসীমা ইসরায়েলের ফ্লাইটগুলোকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরব কিছুটা সময় নিলেও আগামী দিনগুলোতে তারা ইউএই ও বাহরাইনের পথে হাঁটতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব বিরোধিতা করলে বাহরাইন কখনোই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারত না।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌদি বিশ্লেষক বার্নার্ড হেইকেল দেখা করেছিলেন সৌদি আরবের প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবও একই পথে হাঁটছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান শ্যাপিরোর মতে, আরবদেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া ভালো। ইসরায়েল-বাহরাইন সমঝোতাকে অনেক বছরের চেষ্টার ফল হিসেবে উল্লেখ করে তিনি টুইট বার্তায় লিখেছেন, চৌকস কূটনীতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাধানের উদ্যোগে নতুন মাত্রা আনতে পারে।
তবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে সারা বিশ্ব থেকে। ফিলিস্তিনি নেতারা বাহরাইন-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিকে একটি আরব রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইউএই, মিসর ও জর্দান ওই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইরান ও তুরস্ক।