মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমি অক্সফামের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছি।
বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করছি রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য।
৭১-এর বাংলাদেশি শরণার্থী এবং এখনকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেতর পার্থক্য হচ্ছে- ৭১-এ সবাই দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ ছিল। এখন নাগরিকত্বহারা রোহিঙ্গারা নির্যাতনের ভয়ে দেশে ফিরতে চাইছে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারকে যদি বাধ্য করতে না পারে তাহলে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে রোহিঙ্গাদের উন্নত দেশে পুনর্বাসনের জন্য।
রোহিঙ্গা এবং বিশ্বব্যাপী অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের দুর্দশাঃ বিপন্ন মানবতা’ শীর্ষক এক অনলাইন সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, তুরস্ক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, জর্দান, আফগানিস্তান, রুয়াণ্ডা, ঘানা, চীন ও যুক্তরাজ্যের ১৬ জন মানবাধিকার নেতা, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী এবং ভুক্তভোগী শরণার্থী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আজ রবিবার জুম-এ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন ‘বার্মায় গণহত্যা ও সন্ত্রাস তদন্তে নাগরিক কমিশন’-এর সদস্য সচিব বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মাণিক, কমিশনের অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, তুরস্কের ‘টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম’-এর সাধারণ সম্পাদক শাকিল রেজা ইফতি এবং অতিথি বক্তা- রুয়াণ্ডার গণহত্যার ভুক্তভোগী এমেরি মুগবা, আফগানিস্তানের ছাত্রনেতা সৈয়দ মসিহ উল্লাহ হাশিমি, তুরস্কের মানবাধিকার কর্মী সেরহান গোরেন, প্যালেন্টাইনের ছাত্রী লীনা এইসা, সিরিয়ার মানবাধিকার কর্মী রুলা নজর, ঘানার লেখক সাংবাদিক রাজাক মরিয়ম, প্যালেস্টাইনের ছাত্রনেতা রামি খলিলি, উইঘুর ছাত্রী সাবো কোসিমোভা ও তুরস্কের সঙ্গীত ও মঞ্চশিল্পী বিরডাল আরসালান।
সভাপতির ভাষণে শাহরিয়ার কবির রোহিঙ্গাসহ বিশ্বব্যাপী শরণাথীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বলেন জাতিসংঘ ও উন্নত দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিরসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
আমরা দেশে ও বিদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ক এক ডজনেরও বেশি সম্মেলন ও সেমিনারে বলেছি মায়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত না করে জাতিসংঘ তাদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করুক, যেভাবে অতীতে প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান ও ভূটানী শরণার্থীদের ক্ষেত্রে করা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে- জাতিসংঘে চীনের উপর্যুপরি বিরোধিতার কারণে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সপূর্ণভাবে মায়ানমারের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী সেনাবাহিনী ও সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। আমরা চাই রোহিঙ্গা সহ সকল শরণার্থীর দ্রুত নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তন অথবা উন্নত বিশ্বে স্থানান্তকরণ।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৮০ লক্ষ শরণার্থীর ভেতর শতকরা ৮৫ ভাগ আশ্রয় পেয়েছে তুরস্ক ও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। অভিবাসীদের দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে শরণার্থী গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে চীনের অস্ত্র ও রাজনৈতিক মদদ না পেলে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে কখনও নজিরবিহীন গণহত্যা করতে পারত না, এক কোটি নির্যাতিত মানুষকেও শরণার্থী হিসেবে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হত না।
একইভাবে চীনের মদদেই মায়ানমারের সামরিক বাহিনী সেদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে, যার ফলে প্রায় ২০ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, যাদের ভেতর ৭০ ভাগ অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে একটি বিশাল অগ্নিপরীক্ষা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার বারবার বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা আসলেই ভিন্ন। আইসিসির প্রসিকিউটরদের চলমান তদন্তের ফলশ্রুতিতে আইসিসিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি একরকম অনিশ্চিত, কারণ মিয়ানমার এখনও রোম স্ট্যাটুটের অধীনস্ত সদস্য রাষ্ট্র নয়।
তিনি জানান, আইসিজেতে বিখ্যাত গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলার শুনানী স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এবং তারপরও মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়টিকে সে মামলাতে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।
সুতরাং, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশের পক্ষে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কূটনীতি নির্ভর হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কিন্তু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের বাস্তবতায় সে সম্ভাবনার প্রত্যাশা বেশ ক্ষীণই বলা চলে।
সভায় বিভিন্ন দেশের শরণার্থী বক্তারা তাদের দীর্ঘদিনের দুর্দশার কথা তুলে ধরে তুরস্ক ও বাংলাদেশকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান মানবতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুল সংখ্যক বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য।
বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও শরণার্থীরা নির্মূল কমিটির অনলাইন বহুভার্ষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’-এ নিয়মিত লেখার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেন।