কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকারে শেষ হলো বাংলাদেশ ৫ম জাতীয় যুব পরিবার পরিকল্পনা সম্মেলন।
সিরাক-বাংলাদেশ আয়োজিত দুই দিনব্যাপী জাতীয় যুব সম্মেলনটির দ্বিতীয় দিনের মত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বক্তার সমন্নয়ে সেশনের আয়োজন ছিল।
দুইদিন ব্যাপী ভার্চুয়াল সম্মেলনটিতে অংশগ্রহণ করেছেন সারাদেশ থেকে প্রায় ৫০০ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। শুক্রবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনে শুরু হয় এ সম্মেলন।
সম্মেলনে বাংলাদেশ ইয়ুথ হেলথ একশন নেটওয়ার্ক (বিহান), ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ, রাইট হেয়ার রাইট নাও বাংলাদেশ, মেরী স্টোপস বাংলাদেশ, কোয়ালিশন অব ইয়ুথ অর্গানাইজেশনস ইন বাংলাদেশ (সিঅয়াইওবি), পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল, অপশন্স কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড, ইউকেএইড, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, পপুলেশন সার্ভিসেস এন্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ইউবিআর এলাইয়েন্স সহযোগী সংস্থা হিসেবে ছিল।
কোভিড১৯ পরিস্থিতিতেও সিরাক-বাংলাদেশের এমন সাহসী উদ্যোগ নেওয়ায় বক্তারা সাধুবাদ জানান। অনুষ্ঠানস্থলে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বশরীরে কেবলমাত্র বক্তারা ছিলেন এবং অংশগ্রহণকারীরা সম্মেলনের ওয়েবসাইটে বিশেষভাবে নিবন্ধন করে অনলাইন প্ল্যাটফমের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন।
সম্মেলনের ২য় দিনের শুরুতেই ইউএনএফপি বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত তরুণদের জন্য গর্ভনিরোধকের প্রয়োজনীয়তাঃ নিরবতা ভাঙো শীর্ষক সেশনে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট-এসআরএইচআর স্পেশালিস্ট ড. আবু সাইদ মোহাম্মাদ হাসান এর সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন, ইউএনএফপিএ এর রিজিওন্যাল সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজার ড. ভিনিত শর্মা, ওজিএসবির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. সামিনা চৌধুরী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চর্মরোগ ও ভেনেরলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর রাশেদ মোহাম্মাদ খান; এবং প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশের ফাউন্ডার ইসরাত নাহির ইরিনা।
মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আয়োজনে সেশন তরুণদের প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তাঃ সুস্থতার মূলমন্ত্র যেখানে মেরী স্টোপস বাংলাদেশের এডভোকেসি এন্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার মনজুন নাহারের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারী আব্দুস সালাম খান; পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজি আ খ ম মহিউল ইসলাম; মেরী স্টোপস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাসরুরুল ইসলাম; পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর ড. মোহাম্মাদ শরীফ; আনোয়ার খান মডার্ন হসপিটালের গাইনোকোলজিস্ট প্রফেসর ড. সেহরিন এফ সিদ্দিকা এবং যুব প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিরাক-বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার তাসনিয়া আহমেদ।
এছাড়া বাংলাদেশ ইয়ুথ হেলথ একশন নেটওয়ার্ক (বিহান) ও কোয়ালিশন অব ইয়ুথ অর্গানাইজেশনস ইন বাংলাদেশ (সিঅয়াইওবি) এর আয়োজনে সিরাক-বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত এর সঞ্চালনায় পরিচালিত হয় তরুণদের নেটওয়ার্কিং সেশন, যেখানে তরুণ-তরুণীরা সরাসরি তাদের বক্তব্য ও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায়। এবং অপশন্স কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড আয়োজনে সেশন পরিবার পরিকল্পনা সেবায় যুববান্ধব পরিবেশ এবং আমাদের পলিস অপশন্স কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেডের কান্ট্রিলিড ড. নাদিরা সুলতানার পরিচালনায় বক্তা হিসেবে ছিলেন- পপুলেশন কাউন্সিলের কান্ট্রি ডাইরেক্টর ড. ওবায়দুর রব; পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর ডঃ মোহাম্মাদ শরীফ; হ্যান্ডি ক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের প্রজেক্ট অফিসার নাজমা আরা বেগম পপি এবং ইয়াং সিটি চ্যাম্পিয়ন নাজমুল হাসান।
দিনশেষে সমাপনী সেশনে সম্মেলনের সেক্রেটারি জেনারেল ও সিরাক-বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকতের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর ডাইরেক্টর জেনারেল মো. রাশেদুল ইসলাম, ডব্লিউএইচও ডিপার্টমেন্ট অব সেক্সুয়াল এন্ড রিপ্রডাকটিভ হেলথ এন্ড রিসার্চ সাইন্টিস্ট ড. ভেনকাটরামান চন্দ্র মৌলী; ডব্লিউএইচও বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. বরদান জং রানা; জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা. হালিদা হানুম; পপুলেশন সার্ভিসেস এন্ড ট্রেনিং সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক এবং ইউবিআর এলাইয়েন্স এর চেয়ার ড. নূর মোহাম্মাদ; এবং ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য স্পেসালিস্ট ড. দেওয়ান মোহাম্মাদ এমদাদুল হক। এছাড়া সমাপনি অনুষ্ঠানের মুখবন্ধ উপস্থাপন করেন এশিয়া প্যাসিফিক এলায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক এলেক্সান্ড্রা জনস; এবং যুব প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডিজ্যাবিলিটি রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট তাজকিয়া জাহান।
সমাপনি অনুষ্ঠানের মুখবন্ধ উপস্থাপনে এশিয়া প্যাসিফিক এলায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক এলেক্সান্ড্রা জনস তুলে ধরেন বাল্যবিবাহের প্রকটতা, যুবদের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আইসিপিডি ১৯৯৪-এর প্রোগ্রাম অব একশন এর বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা এবং সাউথ এশিয়ায় তরুণদের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নে অগ্রগতি।
যুব প্রতিনিধি ডিজ্যবিলিটি রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট তাজকিয়া জাহান তাঁর বক্তব্যে তরুণদের স্বাস্থ্য সমস্যা, সমাজের কুসংস্কার দূর করা এবং যারা পারসন উইথ ডিজ্যবিলিটিস রয়েছে তাদের অধিকারের ওপর আলোকপাত করেন।
পপুলেশন সার্ভিসেস এন্ড ট্রেনিং সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক এবং ইউবিআর এলাইয়েন্স-এর চেয়ার ড. নূর মোহাম্মাদ বলেন, এই সম্মেলনটি বাংলাদেশের তরুণদের একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম যেখানে সারাদেশ থেকে তরুণ-তরুণীরা অংশগ্রহণ করে। তিনি পরিবার পরিকল্পনার তথ্য ও সেবা সম্প্রসারণ এবং সমন্বিত যৌন শিক্ষার ওপর জোর দেন।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা. হালিদা হানুম বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে ৫৩% মেয়েদের অপরকল্পিত গর্ভধারন হচ্ছে, বিবাহিত কিশোর কিশোরীরা সঠিক সেবা ও তথ্য পাচ্ছে না এবং অবিবাহিতরা ও সব রকম সেবার বাইরে। এতে করে অপরিকল্পিত গর্ভধারন, অসময়ে বিবাহ এবং সঠিক শিক্ষার অভাবে আমরা যুবদের পিছিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রকাশিত “বয়ঃসন্ধি” বইটিতে কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিষদ তথ্য দেয়া আছে। এটি আরও প্রচার প্রচারণা প্রয়োজন।
আমাদের অনেক আইন রয়েছে, পলিসি আছে, শুধু সঠিক প্রয়োগ দরকার এবং সরকার, উন্নয়ন সংস্থাসহ সকলে এক যোগে কাজ করতে হবে।
ডব্লিউএইচও ডিপার্টমেন্ট অব সেক্সুয়াল এন্ড রিপ্রডাকটিভ হেলথ এন্ড রিসার্চ সাইন্টিস্ট ড. ভেনকাটরামান চন্দ্র মৌলী বলেন, লিঙ্গ সমতার অভাব এবং নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা দক্ষিণ এশিয়ায় মূল সমস্যা, নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্য সামগ্রীর সহজলভ্যতা এখনও নিশ্চিত নয়। এই উপমহাদেশের দেশগুলোর মূল সমস্যা বাল্যবিবাহ এবং যেখানে প্রতিবছর হাজারো মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ করছে।
বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ন্যায় বিচার করা। কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের সঠিক যৌন শিক্ষা এবং নেতৃত্বদানের সুযোগ দিতে এরকম সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সমাপনি বক্তব্যে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর ডিরেক্টর জেনারেল রাশেদুল ইসলাম বলেন, সিরাক-বাংলাদেশেকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছে এবং তরুণদের এরকম একটি প্ল্যাটফম তৈরি করে দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ সরকার এবং এনজিও সকলে মিলে আমাদের এসডিজি গোলগুলো বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। তরুণরা আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে উন্নয়নে তরুণদের অংশগ্রহণ অতি জরুরি।
৫ম জাতীয় যুব পরিবার পরিকল্পনা সম্মেলনটিতে সারাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক কিশোর-কিশোরী ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচিব, পরিবার পরিকল্পনা মহাপরিচালকসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বক্তারা বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া আয়োজক সংস্থা, অন্যান্য সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং সারাদেশ থেকে পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণী যুক্ত হন।