আজ রবিবার ১৪ মার্চ ২০২১ কার্ল মার্কস এর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠানটি হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-সিপিবি(এম) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ডাঃ এম এ সামাদ । সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন। আমরা আজ মহামতি কার্ল মার্কস-কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের স্রষ্টা, বিশ্বের মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু নেতা শিক্ষক-মহামতি কার্ল মার্কস, ১৪ মার্চ তাঁর মৃত্যুদিবস মৃত্যুদিবস-( মৃত্যু – ১৪ মার্চ ১৮৮৩ ইং)। প্রাশিয়ার রাইন অঞ্চলের ত্রিয়ার শহরে ১৮১৮ সালে ৫ মে তাঁর জন্ম -শৈশব থেকেই তিনি অসাধারন মেধাবী ছিলেন। মার্কস ক্রিয়ার স্কুলে পাঠ শেষে-প্রথমে বন-য়ে পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে-আইন শাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন। আইনশাস্ত্র পাঠ শেষে
তিনি ইতিহাস ও দর্শন অধ্যায়ন করেন।
১৮৪১ সালে পাঠ সমাপ্ত করে- এপিকিউরসের দর্শন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির থিসিস পেশ করেন। তখনও মার্কস ছিলেন হেগেল পন্থী।
হেগেল যদিও ভাববাদী দার্শনিক-কিন্তু দ্বন্দ্বতত্ত্ব আবিষ্কার ছিল -হেগেলের অন্যতম প্রধান কীর্তি। মহান হেগেল সম্পর্কে- ‘পুঁজি’ ১ম খণ্ডের ১ম অংশে ‘দ্বিতীয় জার্মান সংস্করণের উত্তরভাষ’ – এ মহামতি মার্কসের বলেন, ” আমার ডায়লেকটিক পদ্ধতি হেগেলের পদ্ধতি থেকে শুধু যে ভিন্ন তাই নয়, তার একবারে বিপরীত।
হেগেলের মতে মনুষ্যমস্তিষ্কের জীবন প্রকৃয়া অর্থাৎ চিন্তনপ্রকৃয়া ‘ভাব’ নামে যাকে তিনি একটি স্বতন্ত্র সত্তায় পরিনত করেছেন, তাহা হলো বাস্তব জগতের স্রষ্টা এবং বাস্তব জগৎই সেই ‘ভাবের’ দৃশ্যমান বাহ্যরূপ মাত্র। পক্ষান্তরে আমার মতে মানব মনের মধ্যে বাস্তব জগৎ প্রতিফলিত হয়ে চিন্তার যে বিভিন্ন রূপে পরিনত হয়, ভাব তাছাড়া আর কিছু নয়।” মার্কস যখন পুঁজির প্রথম খণ্ড রচনা করছিলেন তখন হেগেল সম্পর্কে-অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কিন্তু মার্কস প্রকাশ্যেই- হেগেল সম্পর্কে ঘোষণা করেন,”আমি সেই মহান চিন্তানায়কের ছাত্র, এমন কি মূল্যের তত্ত্ব সম্পর্কিত অধ্যায়ে স্থানেস্থানে তাঁর নিজস্ব বিশেষ প্রকাশ ভঙ্গির সঙ্গে প্রণয়রঙ্গও করেছি।”
এসময় মার্কস অধ্যাপক হওয়ার বাসনায় বন শহরে এসেছিলেন – তখন তিনি ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ এর দর্শনিক মতবাদের সাথে পরিচিত হন এবং ফয়েরবাখ অধ্যয়নে মার্কস বস্তুবাদে আকৃষ্ট হন। বস্তুত হেগেল, ফয়েরবাখ, ডারউইন এর তত্ত্ব অধ্যায়ন, গবেষণা মার্কসকে বস্তুবাদী দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ হতে বিশেষ প্রেরণা জোগায়। মার্কস ছিলেন- রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের প্রবক্তা ও আবিষ্কারক।
এনিয়ে ‘মার্কস-এঙ্গেলস স্মৃতি’ বইতে- কমরেড এঙ্গেলস বলেন-“জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম যেমন আবিষ্কার করেছেন ডারউইন, তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাস বিকাশের সুত্র।—।” এঙ্গেলস আরও বলেন-” যুগে যুগে স্থায়ী হবে ওঁর নাম,কীর্তিত হবে ওঁর কৃতি।” বাস্তবেও হয়েছে তাই। আজকের বিশ্বের সর্বসেরা দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী,মেহনতি মানুষের মুক্তির- পথপ্রদর্শক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সর্বময়।
মার্কস এবং তাঁর মহান বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এর প্রধান কীর্তি হলো মার্কসবাদ রচনা করা।
মার্কসবাদ হলো সমাজ বিকাশের তত্ত্ব, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে দ্বান্দ্বিক ভিত্তিতে রচিত তত্ত্ব, দর্শন- মতবাদ। মার্কসবাদ হলো প্রকৃতি,.ইতিহাসের গতি পরিবর্তন ও রূপান্তরের তত্ত্ব। প্রকৃতি, ইতিহাস অনড় অচল স্থির কিছু নয়, সবই গতিময় পরিবর্তনশীল। মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান, দ্বান্ধিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দর্শন। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য- দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নিরিখে বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির- আধুনিক সমাজতান্ত্রিক, সাম্যবাদী সমাজ গড়ার ও শোষণমুক্তির মতবাদ এবং প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানের সমন্বয় ও নিয়ম সমূহের তত্ত্ব।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের আবিষ্কার মহামতি মার্কসের অন্যতম কীর্তিত্ব। ১৮৪৪ সালে মার্কস, এঙ্গেলস এর পরিচয় হয়।.মার্কসের জীবনে এঙ্গেলস এর ভূমিকা অপরিসী, মার্কস এর ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক জীবন, তাঁর দর্শন চিন্তা চেতনা, লিখন -প্রায় সব ব্যাপারেই এঙ্গেলস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মার্কস- এঙ্গেলস ১৮৪৭ সালে বসন্তকালে কমিউনিস্ট লীগে যোগ দেন।
১৮৪৭ সালে নবেম্বরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট লীগের ২য় কংগ্রেসে মার্কস ও এঙ্গেলস সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কংগ্রেসে মার্কস, এঙ্গেলসকে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে-কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশিত হয়।.কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার-সারা বিশ্বেই গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।
তখন ফ্রান্স,জার্মান, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পুঁজিবাদীব্যবস্থা কায়েম হওয়াতে সমাজব্যবস্থায় নতুন এক পলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই পলেতারিয়েত শ্রেণীর সংখ্যা, চেতনা, সাংগঠনিক ভিত্তি বেড়ে -তা শ্রেণীসংগ্রামের চেতনায় রূপ নেয়। এতে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।
তখনকার সময় এর প্রেক্ষাপটে রচিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার।
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার-এ মার্কস- এঙ্গেলস প্রথম বাক্য শুরু করেন এই দিয়ে, ” ইউরোপ ভূত দেখছে কমিউনিজমের ভূত।” এই বাক্য দিয়েই মার্কস -এঙ্গেলস বুর্জোয়া শ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ চূড়ে দিয়েছিলেন, যা পুঁজিবাদী সমাজের শাসক- শোষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশের পর পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এর প্রচার বেড়ে যায়। বুর্জোয়া শ্রেণী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সত্যিই কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার হলো – সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, বুর্জোয়া এবং সর্বহারা শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী সম্পর্ক, শ্রেণীসংগ্রাম এর দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ, সর্বহারা ও কমিউনিস্টদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কমরেড বিন ইয়ামিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোস্তফা আল খালিদ বিন মাহমুদ, কেন্দ্রীয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বিজ্ঞানী কমরেড সামছুল হক সরকার, কমরেড বায়েজিদ হোসেন, গণতান্ত্রিক কৃষক মঞ্চের সভাপতি কমরেড তালিবুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক কমরেড রাসেল, ভাড়াটিয়া কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মাষ্টার সিরাজুল ইসলাম প্রমূখ।