নোয়াখালীর ভাসানচরে সরকারের গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাদের দেখতে বুধবার দ্বীপটিতে পৌঁছেছে জাতিসংঘের প্রথম প্রতিনিধি দলটি।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার কাজে যুক্ত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ১৮ জন কর্মকর্তার এই দলটি নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সকালে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে দুপুরে সেখানে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন ভাসানচর থানার ওসি মো. মাহে আলম।
“ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের কর্মকর্তা ফুমিকো কাশিওয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি ২০ মার্চ পর্যন্ত এখানে অবস্থান করবে,” জানান ওসি।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর বিকেলে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জানিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, “রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে সেখানকার সামগ্রিক অবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে তাঁরা ধারণা নেন।”
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, “জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানতে চেয়েছেন আমরা ভাসানচরে স্বেচ্ছায় এসেছি কিনা। জবাবে বলেছি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছি, কেউ আমাদের জোর করেনি।”
“কক্সবাজারের ক্যাম্পের চেয়ে ভাসানচরে যে আমরা ভালো আছি, সেটিও তাঁদের জানিয়েছি,” উল্লেখ করেন কুতুপালং শিবির ছেড়ে ভাসানচরে যাওয়া এই শরণার্থী।
সেলিমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিনিধি দলের প্রশ্নের জবাবে কেড়ে নেওয়া সম্পদের পাশাপাশি অধিকার বঞ্চিত না হওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া মাত্রই মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গারা।
ইউএনএইচসিআর ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তায় কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার বিশেষজ্ঞরা তিন দিনের এই প্রাথমিক পরিদর্শনে একত্রিত হয়েছেন।”
এই পরিদর্শনের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভাসানচরে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা ও পরিস্থিতি দেখবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্থানান্তরিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হবে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ ও দ্বীপে কর্মরত সব পক্ষের সাথে আলোচনা করা হবে।”
জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা সেখানকার রোহিঙ্গাদের সার্বিক অবস্থা দেখে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে এর আগে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের ডিজি মোহাম্মাদ দেলোয়ার হোসেন।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরুর আগে পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রোটেকশন অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল জাতিসংঘ। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, সরকার অনুমোদন দিলে, জাতিসংঘ প্রায়োগিক এবং সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভাসানচর পরিদর্শন করেছিলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। তখনো কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য দ্বীপটি প্রস্তুত হয়নি।
সংক্ষিপ্ত পরিদর্শন শেষে দ্বীপটিতে আবাসন পরিকল্পনা শুরুর আগে জাতিসংঘকে সেখানে “পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার” জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে সে ধরনের কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করে গত ডিসেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করে সরকার।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বশেষ চলতি মার্চের শুরুতে ভাসানচর পরিদর্শন করে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি’র একটি প্রতিনিধিদল।
ভাসানচর সম্পর্কে বিভ্রান্তি কাটবে
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেরই ভাসানচর সম্পর্কে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছিল— এ কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এক্ষেত্রে কিছু কূটনৈতিক বিষয়ও কাজ করেছে। তবে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটির সফরের ফলে সবার ভুল ধারণা ভেঙে যাবে বলে মনে হচ্ছে।”
প্রতিনিধি দলটি ফিরে এসে নিজেদের মতামত তুলে ধরবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “এতে ভাসানচর যাওয়ার প্রশ্নে কক্সবাজারের যেসব রোহিঙ্গার মধ্যে দ্বিধা আছে তা কেটে যাবে।”
কক্সবাজারসহ পৃথিবীর অন্যান্য শরণার্থী শিবিরের সাথে ভাসানচর প্রকল্পের তুলনামূলক পর্যালোচনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ইউএনএইচসিআর ভাসানচরে কাজ শুরু করলে কক্সবাজারের সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই সেখানে যেতে রাজি হবে।
“কারণ তারা মনে করে এই সংস্থাটিই শুধু তাদের সব চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং ভালো রাখতে পারে,” বলেন তিনি।
শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের এই অধ্যাপকও মনে করেন, “ভাসানচরে বাড়িঘর সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে, সেসব দেখলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ভুল ভাঙবে।”
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতার মুখেই গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার।
কক্সবাজারের শরণার্থী কমিশনার কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর থেকে পাঁচ দফায় ভাসানচরে গেছেন মোট ১৩ হাজার ৭২৩ জন রোহিঙ্গা। এর আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়।
এ ছাড়া এর মধ্যে ভাসানচরে ৩৪ টি রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। সব মিলে বর্তমানে দ্বীপটিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৩ জন।
বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি সম্পর্কে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়, ভাসানচর পুরোপুরি বাসযোগ্য। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে এটি ডুবে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
“বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ভাসানচর অনেক বেশি নিরাপদ,” বলেও উল্লেখ করেন গবেষকরা।
ভাসানচর প্রকল্পের পরিচালক ও নৌ বাহিনীর কমান্ডার এম আনোয়ার