‘নিয়তির নিয়ম মেনে জীবনের অবসান ঘটবে আমাদের সবার। তবে বেঁচে থাকার এই সময়টুকুতে কেউ কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর কেউ বা কিংবদন্তী করে যান নিজেকে। আজ গুণী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি এর প্রয়াণ দিবস। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তের এক রোদন দিনে কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এই কালের সাক্ষী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।
‘প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ একবার বলেছিলেন, “বাংলাদেশে খ্যাত হুমায়ুন আছেন পাঁচজন, কিন্তু হুমায়ুন ফরিদী আছেন একজনই’। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীকে নিয়ে এভাবেই বলেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন, অধ্যাপক এবং কবি হুমায়ূন আজাদ, অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি এবং নিজের কথা উল্লেখ করে এই কথা বলেছিলেন তিনি।”
‘হাজারো মানুষের ভিড়ে হুমায়ুন ফরিদী একজনই ছিলেন আমাদের মাঝে। সেভাবে বলা যায় অনেক অভিনেতার মাঝে তিনিও একজন ছিলেন। অভিনয়কে ভালোবেসে অভিনয়ের সঙ্গে তিনি বেঁধেছিলেন নিজের ঘর। আর সারাটাজীবন সে অভিনয় করেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফরিদী নিজেই বলতেন, “অভিনয় ছাড়া কিচ্ছু পারি না আমি।” মানুষ হাসাতে পারা ছিলো হুমায়ূন ফরিদীর বিশেষ গুণের একটি। শুটিং সেট কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় কৌতুক বলে মাতিয়ে রাখতেন চারপাশ। এত কৌতুক কোথায় পান? এমন প্রশ্নের জবাবে একবার বলেছিলেন, “জীবনটাই তো কৌতুক, আমরা কেউ থাকবো না, থাকবে শুধু কৌতুক।”
‘নিজের জীবনের সাথে কৌতুক করতে করতে অস্তাচলে যাওয়া হুমায়ুন ফরিদী অভাব কখনোই পূরণ হবার নয়, হচ্ছেও না। সব জায়গায় ফরিদী অভাব বোধ হয়! তার চলে যাওয়ার দিনে যেন সেই অভাব আরো বেশি করে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরে। মন খারাপ হয় খুব। আগুন লাগা এই ফাল্গুনও পারে না ফরিদীর প্রয়াণ দিবস ম্লান করে দিতে। তাই মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্র-অভিনয়ের সবখানেই আজ নীরব শোক চলে অবিরাম।
চারিদিকে যখন বসন্তের আগমনী বার্তা ভর করছে, শুকনো পাতারা ঝরে গিয়ে সবুজ নতুন পাতার কুড়িরা উঁকি দিচ্ছে চারপাশে, তখন কেউ কেউ আজ ভীষণ মন খারাপ করবেন প্রিয় মানুষ, প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সঙ্গীর স্মরণে। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন ফরিদীর মৃত্যুবার্ষিকী, দেখতে দেখতে দিন কত দ্রুত চলে গেল।
হুমায়ুন ফরীদি এর মৃত্যুদিনে সেদিন তার বাসভবন পরিণত হয়েছিলো মানুষের সমুদ্রে। শোবিজের নানা অঙ্গনের মানুষেরা সেদিন লোক লজ্জা ভুলে আহাজারি করে কেঁদেছিলেন ফরিদীর জন্য। এভাবে আর কোনো শিল্পীর জন্য কান্না দেখেনি এদেশের মানুষ। হয়তো ব্যক্তিজীবনে খুব বেশি একা ছিলেন বলেই অনেক বেশি মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি।
অভিনয়ের সাবললীতায় মঞ্চ থেকে ছোট কিংবা বড় পর্দায় কোটি মানুষকে মোহিত করেছেন এই অভিনেতা। অভিনয় দিয়ে মানুষকে কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন আবার ক্রোধে জ্বালিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অভিনেতা কমই এসেছে যে কিনা একই সাথে মঞ্চ, টিভি এবং চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
শিল্পী হুমায়ুন ফরিদীর জন্ম ২৯ মে, ১৯৫২ সালে নারিন্দা, ঢাকায়। বাবা এ.টি এম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরী বোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে ফরিদীকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। মা বেগম ফরিদা ইসলাম গৃহিনী।
সুপারহিট মুভি, ওয়েব সিরিজ ও নাটক দেখতে এখানে ক্লিক করুন
ছোটবেলায় ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরিদীকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হতো ফরিদীকে। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল পাস দিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন। এলো একাত্তুর, চলে গেলেন যুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ পরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরেননি। টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরিদী। ছবিঃ সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। এই ক্যাম্পাসেই ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরিদী। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে।
নেগেটিভ-পজেটিভ অর্থাৎ, নায়ক-খলনায়ক দু চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল, এক কথায় ভার্সেটাইল। এক সময়ে মানুষ আর নায়ককে না, এক ভিলেনকে দেখতেই হলে যেতেন। সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলনায়ক ছিলেন ফরিদী। এমন বিরল ইতিহাস আর কোনো চলচ্চিত্র খল অভিনেতা দেখাতে পারেননি। তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ‘এক কাপ চা’ ২০১৪ সালে মুক্তি পায়। তখন তিনি বড় পর্দায় অনিয়মিত।
আলোচনায় ফরিদী কোনোদিন ছিলেন না, এখনো নাই। তিনি ঠাঁই নিয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে, মগজে। ফরিদী আছেন পৃথিবীর সব নাট্যমঞ্চের ড্রেসিং রুমে, পাটাতনে আছেন রুপালি পর্দার সামনে-আড়ালে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল। আর কে পারে এমন করে বসন্তকে কাঁদাতে!