মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ৫ এপ্রিল ১৯৭১ঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যম গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন, গণমাধ্যম কর্মীরাও সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে সংহত ও বিস্তৃত করার কাজে। একাত্তরের এদিনে ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এ সময় দলে দলে লোক ঢাকা ত্যাগ করে। ঢাকায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, ‘প্রদেশের পরিস্থিতি সশস্ত্র বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে।
সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। অবরুদ্ধ ঢাকায় নুরুল আমীনের নেতৃত্বে ১২ জন জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
করাচীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক বিবৃতিতে জানান যে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যেই তিনি জাতীয় পরিষদের দুটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক কোম্পানি যশোর থেকে কুষ্টিয়ার পথে বিশাখালীতে মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশে ট্রেপ বা ফাঁদের গর্তে আটকে যায়। পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে বিশাখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর নির্ভীক যোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শেরপুর-শাদীপুর এলাকায় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। উভয় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং পাকবাহিনীর কাছ থেকে এলাকা দুটি মুক্ত করে।
একাত্তরের এইদিনে টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টে বলা হয়- গত সপ্তাহ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা বোধহয় কেটে যাবে শান্তিপূর্ণভাবেই। কিন্তু তার পর এক নিমেষে পালটে গেল সবকিছুই। তিনটি ঘটনা পুরো দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন জাহাজ থেকে রসদ ও অস্ত্র খালাশ করছিল, বাঙালী জনতা তাদের ঘিরে ফেলে। সৈন্যরা গুলি চালায়, এতে ৩৫ জন বাঙালী মারা যায়। এর প্রতিবাদে বাঙালীদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট ডাকেন। এর অব্যবহিত পরেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকে ‘পাকিস্তানের শত্রু’ বলে ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন তাদের ‘দায়িত্ব পালন’ করতে। ঢাকার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংক আর ট্রাক ট্রাক সশস্ত্র সেনা বেয়নেট উদ্যত রাইফেল হাতে বেরিয়ে আসে। ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে এসব পাকিস্তানী সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালীদের ওপর।
৫ এপ্রিল ১৯৭১ হাউস অব কমন্স সভার আলোচনায় ডগলাস হিউম ও অন্য সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়োগের তীব্র সমালোচনা করেন। হাউস অব কমন্স সভার সদস্যরা পাকিস্তানের ঘটনাকে তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করলেও এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্ত না হওয়ার কথা বললেও পাকিস্তান সরকারকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মীমাংসায় রাজনৈতিক সমঝোতাকে বেছে নিতে অনুরোধ করে। ৫ এপ্রিল হাউস অব কমন্স সভায় ডগলাস হিউম বলেন, ‘[পূর্ব পাকিস্তানে] কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ তথ্য না থাকলেও এটা সন্দেহাতীত যে সেখানে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আমি আশা করছি, এই সংঘাত বন্ধ করতে, পুরো হাউস ও দেশই আমার সঙ্গে পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানাবে’ (সূত্র: হাউস অব কমন্স সভার কার্যবিবরণী, ৫ এপ্রিল ১৯৭১)।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে,ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এ সময় দলে দলে লোক ঢাকা ত্যাগ করে।
ঢাকায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, ‘প্রদেশের পরিস্থিতি সশস্ত্র বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। সশস
্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। পাকিস্তান বিরোধীদের বিরুদ্ধেও যথোচিত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
করাচীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক বিবৃতিতে জানান যে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন করতে চেয়ে ছিলেন। সেজন্যেই তিনি জাতীয় পরিষদের দুটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক কোম্পানি যশোর থেকে কুষ্টিয়ার পথে বিশাখালিতে মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশে ট্রেপ বা ফাঁদের গর্তে আটকে যায়। সামরিক বহরটিতে ৯টি ট্রাক ২টি জীপ ছিল। সৈন্যদের সবাই স্থানীয় কৃষকদের আক্রমণে প্রাণ হারায়।
মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত তাঁর দুই কোম্পানিসহ শেরপুর-শাদীপুর থেকে প্রধান সড়ক হয়ে এবং ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের নিয়মিত সৈনিকরা শ্রীমঙ্গল-কুলাউড়া-কমিগঞ্জএবং চরখানাই-এর পথ ধরে সিলেটের দিকে তৎপরতা শুরু করে।
পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে বিশাখালিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর নির্ভীক যোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
শেরপুর-শাদীপুর এলাকায় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। উভয় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করে এবং পাকবাহিনীর কাছ থেকে এলাকা দুটি মুক্ত করে। এ যুদ্ধে তিন প্লাটুন পাকসৈন্যের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। ইলাশপুর গ্রামের জনৈক দালাল ছাওলা মিয়ার ধানের গোলায় একজন পাকসেনা লুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে গ্রামবাসীরা তাকে খঁজে বের করে এবং হত্যা করে। এ যুদ্ধে শহীদ হন তিনজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আহত তন অসংখ্য।
সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে এক খন্ড যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং তারা পালিয়ে গিয়ে শালুটিকর বিমান ঘাঁটিতে একত্র হয়।
সুরমা নদীর সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তর সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
রাত আটটায় মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রাবাড়ি রোডে পাকসেনা বোঝাই একটি গাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। সাথে সাথে ঢাকা এবং ডেমরা থেকে পাকসেনাদের বহর ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয় এবং গোলাবর্ষণ শুরু করে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। তাঁরা আক্রমণ চালিয়েই সাথে সাথে গ্রামের দিকে চলে যায়।দিনাজপুরের ৮উইং সুবেদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে এক কোম্পানি ইআর, ৯ উইং-এর আরেক প্লাটুন ইপিআরসহ সৈয়দপুর- নীলফামারী সদর রাস্তায় সৈয়দপুরের অদূরে দারোয়ানির নিকট প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে।
পাকবাহিনী ১১টি গাড়ি নিয়ে ভূষিরবন্দর অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির সম্মুখীন হয়। এতে পাকসেনারা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে সৈয়দপুরে পিছু হটে।
দশ মাইল এলাকায় পাকিস্তানিদের সাঁজোয়া এবং গোলন্দাজ বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এত অনেক বাঙালি ইপিআর শাহাদাৎ বরণ করেন এবং অনেকে আহত হন।
তউলন (ফ্রান্স)-এ পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘মনগ্রো’র বাঙালি নাবিকরা ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে। ‘মনগ্রো’-এর ৪৫ জন নাবিকের মধ্যে ১৩ জন বাঙালি নাবিক পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে গোপনে সাবমেরিন থেকে সরে পড়ে। পরে তারা সুইজারল্যান্ডের দিকে যাত্রা করে।
পাহারতলী রেলওয়ে এলাকাতে পাকসেনারা রেলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার আব্দুল হামিদ, এল.আর.খান এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য ও ভৃত্ যসমেত মোট ১১ জন বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করে। এটি পাকসেনাদের নৃশংসতার একটি প্রকাশ।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর,সংগ্রামের নোটবুক ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রতিবেদন।
সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।