করোনা ভাইরাস যার পোশাকি নাম কোভিড-১৯।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগটিকে এখন বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করেছে । এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি বা নভেল করোনা ভাইরাস।
করোনা ভাইরাস রাইবোভিরিয়া পর্বের নিদু ভাইরাস বর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপগোত্রের সদস্য। তারা পজেটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলপড ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যুকে বিনষ্ট করে।
জানুয়ারি মাসে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের কারণে হওয়া কোভিড-১৯ রোগে সারাবিশ্বে আজ পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষের মতো মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশ ও এর বাইরে নয়। জ্বর,কাশি,শ্বাস -প্রশ্বাসের সমস্যাই ভাইরাসটির মূলত প্রধান লক্ষ্মণ। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ, পরে শ্বাস – প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। ভাইরাসটি মহামারী আকার ধারণ করলেও দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি।বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তবে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে বর্তমানে তারা কিছুটা ভরসা পেয়েছেন প্লাজমা থেরাপির উপর। মানুষের রক্তের জলীয় অংশকে বলা হয় প্লাজমা বা রক্তরস। রক্তরসের মধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগই থাকে হলুদাভ রঙের এই প্লাজমা। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে যারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের শরীরে একধরনের অ্যান্টিবডি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার তৈরি হয়। তাদের শরীর থেকে প্লাজমার মাধ্যমে সংগ্রহ করা এই অ্যান্টিবডি যদি করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তখন তার শরীরের সেই অ্যান্টিবডি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তখন অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠেন।
একজন সুস্থ রোগীর শরীর থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা দুই থেকে তিনজন অসুস্থ রোগীকে দেয়া সম্ভব। এখনও করোনা ভাইরাসের কোনো কার্যকর চিকিৎসার উপায় নেই। তবুও চিকিৎসকরা বর্তমানে এই থেরাপির উপর নির্ভর করতে চাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র,চীন, সৌদিআরব, ভারত,মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে সফলভাবে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ করা হয়েছে। সাফল্যের হার ও ভালো।
এপ্রিলমাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। চীনে করোনা ভাইরাসের মহামারী শুরু হওয়ার পর সেখানে এটি নিয়ে প্রথম পরীক্ষা চালানো হয়। শেনঝেন পিপলস হাসপাতাল এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ২৭ শে মার্চ। ৩৬ হতে ৭৩ বছর বয়সী পাঁচজন রোগীর উপর এই পদ্ধতিতে চালানো চিকিৎসার ফল বর্ণনা করা হয়েছে এতে। কোভিড-১৯ থেকে পুরোপুরি সেরে উঠা পাঁচজনের রক্ত সঞ্চালিত করা হয় এই পাঁচ রোগীর দেহে। চীনা গবেষকরা দাবি করেছেন এদের সবাই ১২ দিন চিকিৎসার পর পুরোপুরি সেরে উঠেছেন। এই পদ্ধতির সাফল্য ব্যাপক কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এখনো সম্পূর্ণ প্রমাণিত নয়। তারপর ও এটির মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা। সারাবিশ্বে এই চিকিৎসায় সুস্থতার হার বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের চিকিৎসকরাও প্লাজমা থেরাপিতে আশার আলো দেখছেন।
বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যেই করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি শুরু করা হয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি বেশ পুরোনো একটি পদ্ধতি। দিল্লিতে ইতোমধ্যেই একজন গুরুতর করোনা ভাইরাস রোগী সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। তারপর থেকেই ভারতে করোনা প্রতিরোধে প্লাজমা থেরাপির আশার সঞ্চার করেছে। দিল্লিতে ৪৯ বছর বয়সী কোভিড-১৯ আক্রান্ত একব্যক্তি ভর্তি ছিলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর চিকিৎসায় রক্তরস সম্পর্কিত এই পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছিল যার ফল ইতিবাচক এসেছে।
বর্তমানে এখন গোটা পৃথিবীতেই এই পদ্ধতি নিয়ে চর্চা চলছে। চিকিৎসকদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি দাতা ৪০০ মিলিলিটার পর্যন্ত প্লাজমা দান করতে পারেন, যা অন্তত দুজন রোগীকে দেওয়া যায়। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ব্লাড প্লাজমা দেওয়ার ১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ব্লাড প্লাজমা দিয়ে চিকিৎসার জেরে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার মতো সুসংবাদ এসেছে। জানা গেছে, ব্লাড প্লাজমা প্রথম একজনের শরীর থেকে নেওয়া হয় ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি এক রোগীর শরীরে তা দেওয়া হয়। উহানের জিয়াংসি জেলার একটি হাসপাতালে তাকে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে প্লাজমা দেওয়ার ফলে কিছুটা দুর্বল হয়ে যান দাতা ব্যক্তি। যদিও এতে ভয়ের কিছু নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই প্লাজমা দাতা স্বাভাবিক হয়ে যান। তবে যে কেউ প্লাজমা দিতে পারবে না। তাদের অবশ্যই করোনা ভাইরাস মুক্ত হতে হবে। যখন লোহিত, শ্বেত ও অনুচক্রিকা বর্তমান থাকবে,কেবল তখনই প্লাজমা নিয়ে ব্লাড প্লাটিলেট আবার ও দাতার শরীরে ফিরিয়ে দিতে হবে। প্লাজমা দেওয়ার পর সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ লাগে স্বাভাবিক হতে। যদিও করোনা ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি,তবুও গবেষকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারী এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসার এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা,সার্স এবং ‘এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান’ এর মতো রোগের চিকিৎসার ও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় বিজ্ঞানীরা কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন।
নামঃ ইসরাত জাহান, শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়