‘আমি একজন সহিহ মানুষ। কোনো ভেজাল করি নাই’- র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর প্রথমে এই কথা জানিয়েছিলেন প্রতারক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। সাহেদকে গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। এ ছাড়া সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতালে টেস্ট না করে করোনার ভুয়া সনদ দেওয়ার কথা প্রথমে অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, তার স্টাফরা এসব করেন। তিনি কিছু জানতেন না। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে নিজের সম্পৃক্ততাসহ বিস্তারিত স্বীকার করেন সাহেদ।
এদিকে সাহেদের মহাপ্রতারক হয়ে ওঠার তদন্ত শুরু হয়েছে। কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আজকের সাহেদ তৈরি হয়েছে, সেটি তদন্তে প্রাধান্য পাচ্ছে। সাহেদের গডফাদারদের সম্পর্কে ইতোমধ্যে তথ্য এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। তবে তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে কারও নাম প্রকাশ না করলেও সবার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হচ্ছে।
সাহেদ এর আগেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানাপুলিশ একটি প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করেছিল। তবে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে যান। ওই বছর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা খোলেন সাহেদ; কিন্তু বিপুল পরিমাণ টাকার পোশাক বাকি নিয়ে আর শোধ করেননি। এরকম এক ব্যবসায়ীর ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে আদালতে মামলা হয়।
ওই গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাহেদকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসার পরপরই শুরু হয় ফোন আসা। অনেক ফোন আসতে থাকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কলও ছিল। তাকে গ্রেপ্তার করার আগে তো কিছু বুঝিনি। ফোন আসা শুরু হলে আমরা ভেবেছিলাম তিনি গুরুত্বপূর্ণ।’
সাহেদ করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা এবং রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আব্দুল বাতেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এ কথা বলেন।
বাতেন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রতারণার কথা স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের বেশকিছু মেশিনপত্র র্যাবের অভিযানের আগেই সরিয়ে ফেলার কথাও বলেছেন। তাকে রিমান্ডে আনা হয়েছে, দেখা যাক জিজ্ঞাসাবাদে কী কী বলেন।’
সাহেদের মামলার তদন্তভার চেয়ে আবেদন করেছে অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা র্যাব। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছি আমরা। তদন্তে যাদের নাম আসবে, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
সাহেদ ১০ দিনের রিমান্ডে: করোনা টেস্ট না করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার সাহেদ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ১০ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর আরও ৭ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করা হয়।
১০ দিন করে রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মাদ জসিম এ রিমান্ডের আদেশ দেন।
এদিকে মিডিয়ায় কিছু ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্যই পরিস্থিতির শিকার হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হয়েছে বলে বিচারকের কাছে সাহেদ দাবি করেছেন। তিনি এ সময় কান্নাকাটিও করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্তদের আদালতে হাজির করে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মাইক্রোবাসে আসামিদের আদালত অঙ্গনে আনার পর সরাসরি তাদের সিএমএম আদালতের সাততলার ১৮ নম্বর এজলাস কক্ষে ওঠায়। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক এসএম গাফফারুল আলম আসামি সাহেদ ও মাসুদ পারভেজের ১০ দিন করে এবং তারেক শিবলীকে ৫ দিনের রিমান্ডের পর ফের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন।
প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি কেএম সাজ্জাদুল হক শিহাব, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ বলেন, ‘আসামিরা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ ও জাল-জালিয়াতি করেছে। মহামারী করোনা পরীক্ষা না করেই মানুষকে নেগেটিভ-পজিটিভ সার্টিফিকেট দিয়েছে। তাদের ওই জাল-জালিয়াতির রিপোর্টের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্য হয়েছে। তারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে তদন্ত কর্মকর্তার প্রার্থিত মতে রিমান্ড মঞ্জুর করা হোক।’
অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট নাজমুল হোসেন, মনিরুজ্জামান, শাহ আলম রিমান্ড বাতিল করে জামিন আবেদন করেন। রিমান্ড বাতিলপূর্বক তার পক্ষের আসামির জামিন আবেদনের শুনানি করাকালে সাহেদ কাঠগড়া থেকে কিছু বলার জন্য বিচারকের কাছে অনুমতি চান। বিচারক অনুমতি দিলে সাহেদ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘করোনা রোগীদের পরীক্ষা যখন বাংলাদেশে শুরু হয়, তখন আমার হাসপাতালেই ঝুঁকি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তি করে করোনার চিকিৎসা শুরু করি। শত শত করোনা রোগীর চিকিৎসা করেছি। বলা হচ্ছে- আমার হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৪ সালে; কিন্তু তা সত্য নয়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন আছে। এর পর তা রিনিউ করতে দেওয়া হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন। এখানে আমার কোনো অবহেলা নেই। তাই লাইসেন্স নেই বলা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেই তিনি নিজে যেমন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তার বাবাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া তার এমডিসহ অনেক অফিসারই আক্রান্ত হয়েছেন।’ সাহেদ বলেন, ‘মিডিয়া কিছু ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য আজ পরিস্থিতির শিকার হয়ে এখানে এসেছি।’
সাহেদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তার (সাহেদ) বক্তব্য মিথ্যা বলে আদালতের কাছে দাবি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে সাহেদ ও মাসুদ পারভেজের ১০ দিন এবং তারেক শিবলীর পুনরায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আমাদের সাতক্ষীরার নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, করোনার ভুয়া টেস্ট ও জাল সনদপত্র প্রদানসহ প্রতারণার অভিযোগে সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর তাকেসহ তিনজনকে আসামি করে দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেছে র্যাব। গত বুধবার রাতে র্যাব ৬-এর ডিএডি নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে দেবহাটা থানায় মামলাটি করেন। মামলা নং-৫। মামলায় প্রতারক সাহেদ করিমকে প্রধান আসামিসহ নৌকার মাঝি বাচ্চুকে পলাতক আসামি ও আরও একজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলাটি দায়ের করা হয়।
দেবহাটা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, র্যাবের পক্ষ থেকে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলায় প্রতারক সাহেদকে মূল আসামি এবং একজনকে পলাতক ও আরও একজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরার কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান পরিচালনাকালে উঠে আসে রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়মের ভয়াবহ সব তথ্য। পরীক্ষা না করেই দেওয়া হতো করোনা পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট। পরে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুরের শাখা সিলগালা করে দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত আর করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে র্যাব।