বিশ্লেষনের শুরুতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ এর অন্তর্ভূক্তি নিয়ে ক্ষুদ্র আলোকপাত করা যাক । ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমেরিকার নিকট এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের জন্য অনুরোধ করে । কিন্তু সেই সময় দেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা অনুকুলে না থাকায় আমেরিকা এফ-১৬ বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানায় । অতঃপর রাশিয়ার নিকট মিগ-২৯ বিক্রির জন্য অনুরোধ জানালে রাশিয়া তা বিক্রি করতে সম্মত হয় এবং রাশিয়া থেকে ৮ টি মিগ-২৯ ক্রয় করার জন্য চুক্তি করা হয় ৷
মিগ-২৯ অন্তর্ভুক্তির পর পর ক্ষমতার পালাবদলে আসে বিএনপি । আর তখনই শুরু হয় দেশের প্রতিরক্ষাখাতে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক নোংরামীর ইতিহাস । ক্রয়সংক্রান্ত দূর্নীতির অভিযোগ তুলে ৮ টা মিগ-২৯ কে সম্পূর্ণ গ্রাউন্ডেড করা হয় এবং পাইলটদের এই বিমান চালানো হতে পুরোপুরি অব্যহতি দেওয়া হয় । এছাড়াও তারা তখনকার সময়ে পুরো দক্ষিন এশিয়ার সেরা ফ্রিগেট বিএনএস বঙ্গবন্ধুকেও ডিকমিশন্ড করে । এসময় মিগ সংক্রান্ত নাটক রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে ।
পরবর্তীকালে তত্বাবধায়ক সরকারের সময় মিগগুলোকে পুনরায় সার্ভিসে আনা হয় । কিন্তু ততোদিনে মিগগুলোকে ওভারহলিং করার প্রয়োজন পড়ে এবং সে কারনে কিছু মিগ পর্যায়ক্রমে রাশিয়ায় পাঠানো হয় । এরপর আওয়ামীলীগ সরকারের প্রথম দিকে বাকি মিগগুলোকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় মিডলাইফ ওভারহলিং সম্পন্ন করার জন্য ।
পরবর্তীকালে মিগ-২৯ এর আপগ্রেডেশন সহ ৮ টি মিগ-২৯ এর জন্য রাশিয়ার কাছে অনুরোধ করলে রাশিয়া অত্যধিক মূল্য চেয়ে বসে । এ কারনে কিছুদিন অপেক্ষা করার পর বেলারুশে পাঠানো হয় আপগ্রেড করার জন্য । পরবর্তীকালে এগুলোকে আবার ওভারহলিং করার জন্য রাশিয়ার দ্বারস্থ হলে রাশিয়া পূর্বের মতোই একগুয়েমি করে অত্যধিক মূল্য চেয়ে বসে ৷ তাই আবারো বেলারুশে পাঠানো হয় ওভারহলিং এর জন্য ।
অস্ত্রব্যবসায় রাশিয়ার মাফিয়াগিরির অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে আমাদের MRCA প্রোগ্রাম । বাংলাদেশ প্রথমে সু-৩০ এসএমই নিতে চাইলে পরবর্তীতে আমরা সু-৩৫ এর প্রতি আগ্রহী হই এবং সেভাবেই টেন্ডার এবং বাজেট তৈরি করা হয় । কিন্তু রাশিয়া আলাদাভাবে শর্তজুড়ে দেয় সু-৩৫ নিতে হলে মিগ-৩৫ ও নিতে হবে । ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে রাশিয়ার মুখোশ উন্মোচন হলে বিমানবাহিনী সেদিকে না এগিয়ে টেন্ডারে বড়সড় পরিবর্তন আনে । মূলত রাশিয়ার এই নাটকের জন্যই আমাদের MRCA প্রোগ্রাম বিলম্বিত হয় । এগুলো ছাড়াও রাশিয়া ইউক্রেনকে আমাদের দেশে মিগ-২৯ এর জন্য ওভারহলিং প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যেগকে বাধা দেওয়ার চেস্টা করে ।
বর্তমানে আমাদের বিমানবাহিনী রাশিয়া নির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠার চেস্টা করছে ৷ বেলারুশের সহায়তায় দেশে এমআই-১৭১ হেলিকপ্টারের ওভারহলিং ফ্যাসিলিটি গড়ে উঠেছে । এছাড়াও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মিগগুলোতে এন্টিশীপ অস্ত্রের ক্যাপাবিলিটি অর্জনের জন্য বেলারুশের সহায়তায় এগুলোকে আপগ্রেড করা হচ্ছে ৷ বলাবাহুল্য মিগ-২৯ এর বহর পূর্ণ করার জন্য আর কোনো নতুন রাশিয়ান বিমান যুক্ত করা হবেনা । তাই ধরা যায় ২০৩০ এর পর ইয়াক-১৩০ ট্রেনার আর এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার এবং রাডার বাদে বিমানবাহিনীতে আর কোনো রাশিয়ান প্রোডাক্ট দেখা যাবেনা ।
রাশিয়ার অস্ত্রব্যবসায় এধরনের মাফিয়াগিরির জন্য ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী রাশিয়ান অস্ত্রের প্রসার কমে আসছে । ভারতের মতো নির্ভরযোগ্য ক্রেতাও রাশিয়ান অস্ত্রের উচ্চ রক্ষনাবেক্ষন , ডাউনগ্রেড কোয়ালিটি সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং স্ক্যান্ডালের জন্য রাশিয়াবিমুখ হয়ে পশ্চিমা যুদ্ধবিমান রাফালের দিকে ঝুকেছে । রাশিয়া বাদে কিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশ , চীন এবং কিছু উত্তর আফ্রিকার দেশ বাদে রাশিয়ান অস্ত্রের ব্যবহারকারী আর উল্লেখযোগ্য নেই । পোল্যান্ড , বুলগেরিয়া , স্লোভাকিয়ার মতো একসময় রাশিয়ার বলয়ে থাকা দেশগুলো আজ পশ্চিমা বিমান সংগ্রহ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ।
সহজ শর্তে ঋন দিয়ে ডাউনগ্রেড কোয়ালিটির ইক্যুপমেন্ট সরবরাহ করে তাতে ডাউনগ্রেড স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ করে অর্ডার ঝুলিয়ে রাখার মতো বাটপারি বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার অস্ত্রব্যবসার জন্য অশনি সংকেত ডেকে নিয়ে আসবে তা জোর গলায় বলা বাহুল্য!