অবশেষে ১০ই নভেম্বর ২০২০ এ রাশিয়ার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং মধ্যস্থতায় অবসান হলো আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে চলা ২৭শে সেপ্টেম্বর থেকে ৯ই নভেম্বর পর্যন্ত ৪৪ দিনের এক সংক্ষিপ্ত এবং ভয়াবহ যুদ্ধ। আসলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া আলোচনার টেবিলে চূড়ান্ত যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় এবং চুক্তির সকল প্রস্তাব মেনে নিয়ে নতুন এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই যুদ্ধ বিরতির চূড়ান্ত চুক্তিতে আজারবাইজান অনেকটাই লাভবান হলেও রাশিয়া কিন্তু অত্যন্ত সুকৌশলেই তার নিজের স্বার্থ ঠিকই হাসিল করে নেয়। তবে যে যাই বলুক না কেন, এই যুদ্ধ বিরতিতে আর্মেনিয়া কিন্তু নিজেই অনেকটাই সুরক্ষিত এবং লাভবান হয়েছে। তার কারণ যুদ্ধ আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ চালু থাকলেই আর্মেনিয়াকে নিশ্চিতভাবে নার্গানো-কারাবাখসহ আরো নতুন নতুন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আজারবাইজান সেনাবাহিনীর কাছে হারাতে হতো।
মুলত রাশিয়া এবং ইউরোপের বেশকিছু দেশের উস্কানিতে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রাণঘাতী যুদ্ধে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের অংশ নার্গানো-কারাবাখ অঞ্চল অবৈধভাবে দখল করে রাখে এবং বিভিন্ন সময়ের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সেনা ও সাধারণ নাগরিক মৃত্যবরণ করলেও ৭০% পর্যন্ত হতাহত আজারবাইজানের হতে থাকে। তবে আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী তার নিজস্ব মাতৃভূমির অংশ নার্গানো-কারাবাখ উদ্ধারে এর আগে অসংখ্য বার সামরিক সংঘর্ষে জড়ালেও তাতে তেমন একটা সফলতা আসেনি। আর জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত নার্গানো ও কারাবাখ অঞ্চল উদ্ধারে এবার তুরস্ক এবং ইসরাইলের সামরিক সহযোগিতায় চূড়ান্ত যুদ্ধে নামে আজারবাইজান। দেশটির সেনাদের অদম্য সাহসিকতা এবং বিশেষ করে তুরস্ক ও ইসরালের সরবরাহ করা সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও উচ্চ প্রযুক্তির কামিকাজ কিংবা বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন (ইউএভি) এর ব্যাপক ব্যবহারে আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনী কোন অবস্থায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আর এই যুদ্ধে আজারবাইজানের সেনাবাহিনী প্রচলিত যুদ্ধ ব্যবস্থা থেকে অনেকটাই সরে এসে তুরস্কের সামরিক ছক ও পরিকল্পনায় ব্যাপক মাত্রায় কমব্যাট ড্রোনের সফল ও ব্যাতিক্রমী ব্যবহার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশেষজ্ঞদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। আবার কেন জানি ইউরোপের দেশগুলো আর্মেনিয়ার এই সাম্প্রতিক শোচনীয় পরাজয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
যুদ্ধের একেবারেই শুরু থেকেই তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকটাই প্রকাশ্যেই সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহ এবং যুদ্ধ কৌশল ও ছক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেলেও শেষে এসে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ বিরতিতে বাস্তবিক অর্থে তেমন কিছুই পায়নি তুরস্ক। যেখানে কিনা নব্বই-এর দশকের শুরুর দিকে নাগোর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের ভয়াবহ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আজারবাইজানে অস্ত্র ও সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল তুরস্ক। আর সবশেষে ২০১০ সালে তুরস্ক এবং আজারবাইজান সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তিতেও সই করে।
যদিও আজারবাইজান এবং তুরস্ক শুরু থেকেই শান্তিরক্ষী মিশনে তুরস্কের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ এবং সাবলীল উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়ে আসছিল। তবে রাশিয়ার করা যুদ্ধ বিরতির শান্তি চুক্তিপত্রে তুরস্কের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে কিছুই অন্তভুক্ত করা হয় নি। এদিকে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ জানিয়েছেন যে, নার্গানো-কারাবাখ অঞ্চলে শান্তিরক্ষা মিশনে তুর্কি সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে।
এদিকে রাশিয়ার তাস নিউজের তথ্যমতে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেভরভ জানিয়েছে, “নার্গানো-কারাবাখ অঞ্চলে শান্তিরক্ষা মিশনে তুরস্কের অংশগ্রহণ সম্ভব নয় এবং তুরস্ক অংশগ্রহণ নিয়ে যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে কোন কথাই উল্লেখ করা হয়নি।“
অবশ্য এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে এরদোয়ানের দেশ তুরস্কের সবচেয়ে বড় অর্জনটি হল বিশ্বজুড়ে তার বাস্তব যুদ্ধে সামরিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার বিষয়টি তুলে ধরা। অন্যদিকে সংক্ষিপ্ত এই যুদ্ধে আজারবাইজানের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার বিরোধী গ্রীস সমর্থিত ইউরোপীয় লবির কাছে পরাজিত হওয়ার অনেকটাই বদলা নিতে সক্ষম হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে তুরস্ককে খুশি রাখতে সীমান্ত সংলগ্ন আজারবাইজানের ভূখণ্ড নাখচিভান ছিটমহল থেকে আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য একটি করিডোর তৈরি এবং ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এই নতুন চুক্তিতে। তবে তুরস্কের সব থেকে বড় অর্জন কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত হয়ে গিয়েছে। আর তা হলো যুদ্ধক্ষেত্র বা সামরিক রণাঙ্গনে ভিন্ন মাত্রায় ড্রোন, জ্যামারসহ আরো বেশকিছু উচ্চ প্রযুক্তির সিস্টেমের সফল প্রয়োগ এবং এর বাস্তব ব্যবহার। যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই রাশিয়া বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র, ট্যাংক, আর্টিলারী, যুদ্ধবিমান, এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং আরো প্রয়োজনীয় সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহ করে গেলেও বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলো তেমন একটা কার্যকরিতা বা সফলতা দেখাতে পারেনি। এদিকে তুরস্ক এবং ইসরাইলের নিজস্ব প্রযুক্তির সরবরাহ করা ড্রোন, মিসাইল এবং অন্যান্য সামরিক সাজ সরঞ্জামের কাছে শোচনীয়ভাবে ধ্বংস হতে থাকে রাশিয়ার কথিত অত্যাধুনিক অস্ত্র।
বৈশ্বিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকেরা আজারবাইজানের যুদ্ধ বিজয়কে পরোক্ষভাবে রাশিয়ার বিপক্ষে তুরস্কের বিজয় হিসেবে দেখছেন। পাশাপাশি তুরস্কের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কিন্তু ঠিকই বিশ্বের সামনে প্রবলভাবে উম্মোচিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিশ্বের একাধিক রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা এবং যুদ্ধ ব্যবস্থাপনার কৌশল ও দক্ষতা বিগত কয়েক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই দেখিয়ে আসলেও বর্তমানে তা কিন্তু তুরস্কের এরদোয়ান সামরিক বাহিনী করে দেখিয়েছে। বর্তমানে তুরস্ক একই সাথে ইরাক, সিরিয়া ও লিবায়ায় বেশকিছু দেশের বিপক্ষে যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়লেও তার পাশাপাশি তুরস্ক তাদের সীমিত অর্থনীতি সক্ষমতার উপর নির্ভর করে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় সফলতা দেখিয়েছে। যা নিশ্চিতভাবে তুরস্কের পাশে থাকা বৈরি গ্রীস এবং অতি উৎসাহী কিছু ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে এক ভয়ঙ্কর বার্তা পৌছে গেছে। বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো ব্যাতিত আপাতত তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি অস্ত্র, সামরিক সাজ সরঞ্জাম, উচ্চ মাত্রায় যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ রণকৌশলের কাছে মাধ্যম কিংবা ছোট দেশের সামরিক বাহিনী দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না।
তবে যাই হোক না কেন, এই আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ বিরতি চুক্তির আওতায় রাশিয়া এখন দীর্ঘ সময়ের জন্য নার্গানো-কারাবাখ অঞ্চলে শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং তার সাজোয়া বহর ও রসদ প্রেরন শুরু করে দিয়েছে। আর শান্তিরক্ষার নামে রাশিয়া এখন কিন্তু এক রকম বিনা বাধায় সেখানে দীর্ঘ সময়ে অবস্থান করার সুযোগ পেয়ে গেল। যা কিনা ভবিষ্যতে আজারবাইজান, তুরস্ক এবং এমনকি ইরানের জন্য চরম মাত্রায় হুমকী হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, ককেশীয় অঞ্চলসহ ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া সংলগ্ন সীমান্তের অন্য কোন দেশে বা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে শান্তি রক্ষার নামে রাশিয়ান সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হলে তা পরবর্তীতে আর কোন দিনই ফিরিয়ে আনা হয়নি। বরং বিভিন্ন কৌশলে রাশিয়া সেখানে তার সামরিক অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। তাছাড়া রাশিয়ার মতের বিরুদ্ধে থাকায় পুতিন প্রশাসন প্রতিনিয়ত জর্জিয়াকে সামরিক হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। আর ইতোমধ্যেই সুকৌশলে বিদ্রোহ ঘটিয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ ইউক্রেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্রিমিয়া প্রকাশ্যেই দখল করে নেয়ার মতো জঘন্য কাজ করায় একে খুব সহজে বিশ্বাস করাটা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে দেখা দিতে পারে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com