১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি এফ-১৬ এ/বি সিরিজের জেট ফাইটারের আন্তর্জাতিক বাজারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১৫ থেকে ১৬ মিলিয়ন ডলার এবং এফ-১৬ সি/ডি সিরিজের বিক্রয়মূল্য ছিল ১৯ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার। অথচ বর্তমান সময়ে মার্কিন লকহীড কর্পোরেশন তাদের সর্বশেষ সিরিজের এফ-১৬ ব্লক-৭০/৭২ সিরিজের জেট ফাইটারের মূল্য নির্ধারণ করেছে (ওয়েপন্স এণ্ড মেইন্টেনেন্স প্যাকেজসহ) আনুমানিক ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার।
আবার বিভিন্ন সিরিজের জয়েন স্টাইক এফ-১৫ ঈগল জেট ফাইটারের দাম ছিল ১৯৯৭ সালে ২৮ থেকে ৩৩ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ছিল। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রচ্যের ছোট্ট দেশ কাতার ২০১৭ সালে ৩৬টি এডভান্স এফ-১৫কিউএ সিরিজের জেট ফাইটার ১২.০০ বিলিয়ন ডলারে (ওয়েপন্স এণ্ড মেইন্টেনেন্স প্যাকেজসহ) ক্রয়ের চুক্তি করে। সে হিসেবে কাতারের আল থানী সরকারকে মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশনকে প্রতিটি এডভান্স এফ-১৫ জেট ফাইটারের জন্য ৩৩৪ মিলিয়ন ডলার প্রদান করতে হয়েছে।
এদিকে ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী ফ্রান্সের রাফায়েল-এম এডভান্স জেট ফাইটারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৮২ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১২ সালের দিকে (এমআরসিএ) প্রজেক্টের আওতায় ভারতের আগের কংগ্রেস সরকার ফ্রান্সের কাছ থেকে ১২৬টি ৪++ প্রজন্মের রাফায়েল-এম সিরিজের এডভান্স জেট ফাইটার ক্রয়ে (মেইন্টেনেন্স ও স্পেয়ার পার্টস সাপ্লাইসহ ফুল প্যাকেজ) প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল চুক্তি সম্পন্ন করে। সে অনুযায়ী প্রতি ইউনিট রাফায়েলের দাম পড়ে ১৫৮.৭৩ মিলিয়ন ডলার এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৮টি রাফায়েল জেট ফাইটার ফ্রান্সের ডেসাল্ট কোম্পানি সরাসরি সরবরাহ করবে এবং অবশিষ্ট্য ১০৮টি রাফায়েল-এম সিরিজের জেট ফাইটার ভারতের হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিকস লিমিটেডের এভিয়েশন ফ্যাসালিটি প্লান্টে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে নিজ দেশের মাটিতেই তৈরি করা হবে।
অথচ ২০১৬ সালে ভারতের মোদি সরকার পূর্বের চুক্তি বাতিল করে নতুন ৩৬টি রাফায়েল জেট ফাইটার ৮.৮০ বিলিয়ন বা প্রতি ইউনিট ২৪৪.৪৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৩৮.৮৮ ভারতীয় রুপি মূল্যে ক্রয়ের নতুন চুক্তি সম্পন্ন করে। অবশ্য চুক্তি মোতাবেক ভারতের বিমান বাহিনী চলতি ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথম ব্যাচে ৫টি ফ্রান্সের রাফায়েল হাইলী এডভান্স ৪++ জেনারেশনের জেট ফাইটার হাতে পেয়েছে।
এখানে খেয়াল করার মতো একটি বিষয় হলো যে, মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা আমীর শাসিত আরব দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে চলমান দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং নিজেদের মধ্যে বিরোধ, অবিশ্বাস, কিংবা প্রবল মতানৈক্যের কারণে এবং এমনকি ভবিষ্যতে তুরস্ক এবং ইরানের প্রভাব বিস্তারের প্রবল আশাঙ্খায় আতঙ্কিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় কিংবা সংগ্রহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পথে হাটা শুরু করে দিয়েছে।
তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে ক্রয়কৃত অস্ত্রের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অপেক্ষা তিনগুণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কিংবা এমনো হতে পারে যে, মানবাধিকার লংঘনের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে এসব সুপার পাওয়ার দেশের মুখ বন্ধ করে রাখতে প্রয়োজনে পাঁচগুণ বেশি দামে অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম ক্রয়ে কোন রকম দ্বিধা করে না এরা। আর এই অবস্থায় পুরোপুরি সুযোগ নিয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে অতি মুনাফা লোভী বিশ্বের প্রথম সারির ডিফেন্স ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন ও কোম্পানিগুলো।
বর্তমানে এসব আরব ধনী দেশের পাশাপাশি বিশ্বের কিছু অতি চালাক দেশের নির্বুদ্ধিতা ও অতিরিক্ত দামে সাজ সরঞ্জাম ডিফেন্স হার্ডওয়ার সিস্টেম ক্রয়ের জন্য জটিলতায় পড়তে হচ্ছে মধ্যম ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে। ডিফেন্স জায়ান্ট কর্পোরেশনগুলো এখন আর কিন্তু স্বল মূল্যে কারো কাছে ডিফেন্স সিস্টেম বিক্রয় কিংবা সরবরাহে রাজি নয় এবং এক্ষেত্রে আমাদের মতো সাধারণ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও যুদ্ধবিমান ক্রয় এবং সংগ্রহ করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
চলতি ২০২০ সালের ১৭ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সামরিক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন’ বিশ্বের সর্বোচ্চ রেভিনিউ অর্জনকারী ১০০টি ডিফেন্স রিলেটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন এবং কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করে। আর এই তালিকায় বরাবরের মতো প্রথম পাঁচটি কর্পোরেশনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৫০টি ডিফেন্স এণ্ড মিলিটারি রিলিটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন বা কোম্পানি জেয়গা করে নেয়। যদিও অবশ্য এই তালিকাটি ২০১৯ সালে কোম্পানিগুলোর সর্বোচ্চ নীট রেভিনিউ বা রাজস্ব আয়ের বিবেচনা করে তৈরি করা হয়েছে। সে হিসেবে ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেভিনিউ অর্জনকারী ডিফেন্স রিলেটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন হচ্ছে মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন। ২০১৯ সালে মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন ৫৬.৬০৬ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ অর্জন করে প্রথম স্থানে রয়েছে। তাছাড়া ৩৪.৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশন, ২৯.৫১২ বিলিয়ন ডলার আয় করে মার্কিন জেনারেল ডাইনামিক্স তৃতীয় স্থানে, ২৮.৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করে মার্কিন নরথ্রপ গ্রুম্যান চতুর্থ স্থানে এবং ২৭.৪৪৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রেভিনিউ অর্জন করে মার্কিন রেইথন কোম্পানি পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
তাছাড়া ২০১৯ সালে অন্যান্য দেশের তালিকায় ফ্রান্সের ডেসাল্ট কোম্পানি রেভিনিউ অর্জন করেছে ৫.৭১ বিলিয়ন ডলার। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ কো-অপারেশন অব চায়না আয় করেছে ২৫.০৮ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেম আয় করেছে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার, এয়ারবাস ১১.২৭ এবং ইতালীর লিয়োনার্দো ডিফেন্স কোম্পানি ১১.১১ বিলিয়ন রাশিয়ার আলমার্জ এন্টি ১০.২০ বিলিয়ন ডলার, জাপানের মিসিবিসি হেভী ইন্ডাস্ট্রিজ ৬.৫৮ বিলিয়ন ডলার, চায়না সাউথ ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ কর্পোরেশন ৮.৮৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্যের রোলস রয়েস ৪.৭১ বিলিয়ন ডলার আয় করে। তাছাড়া বিশ্বের আরো অনেক দেশের ডিফেন্স ইণ্ডাস্ট্রিজ বা গ্রুপ অব কোম্পানি রয়েছে বিলিয়ন ডালার আয় অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায়।
উপরের প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তে এটাই প্রমান হয় যে, বর্তমানে বিশ্বের জায়ান ডিফেন্স ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশনগুলো কম দামে শুধু যুদ্ধবিমান বা সামরিক সাজ সরঞ্জাম ক্রেতা দেশেরগুলোর কাছে বিক্রয় করতে আগ্রহী নয়। তারা সুকৌশলে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো সিণ্ডিকেট করে মেইন্টেনেন্স, সার্ভিসিং, স্পেয়ার পার্টস সাপ্লাই ইত্যাদি নামে ও অযুহাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত। যুদ্ধবিমান কিংবা সামরিক সাজ সরঞ্জাম কিনতে এখন হলে তাদের শর্ত মেনে ওয়েপন্স ও মেইন্টেনেন্স প্যাকেজসহ তিনগুণ বেশি দামে ক্রয় করতে হয় ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়কারী দেশগুলোকে। এগুলো আবার শুধু কিনলেই হবে না যুগের পর যুগ সচল রাখা ও আপগ্রেডিং এর পিছনে ব্যয় করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আর এভাবে গ্লোবাল জায়ান্ট এভিয়েশন এবং অন্যন্য ডিফেন্স কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা লুটে নিচ্ছে খুব সহজেই। আসলে এটা হচ্ছে আধুনিক যুগের বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর আগ্রাসী ও সম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ এবং অন্য দেশের সম্পদ লুন্ঠনের এক ভয়াবহ ও নব্য কৌশল মাত্র।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com