পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত এবং অত্যাধুনিক বেশ কিছু যুদ্ধাস্ত্র বানিয়েছে চীন। সামরিক শক্তির বিচারে সমুদ্র, আকাশ, মহাকাশ, ইন্টারনেট—সব ক্ষেত্রেই নিজেদের অন্যতম শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরই মধ্যে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বেইজিং। ভারত মহাসাগরজুড়েও ক্রমাগত নিজেদের আধিপত্য বাড়িয়ে চলেছে তারা। খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের অভাবনীয় শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য তাইওয়ানের ওপর সামরিক অভিযানও চালাতে পারে চীনের সেনারা, অর্থাৎ পিপলস লিবারেশন আর্মি।
জে ১০ হচ্ছে চীনের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার জেট।এর ডানা হচ্ছে ত্রিভুজাকৃতির যেটাকে ডেল্টা ডানা বলা হয়।ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই বিমানে কানার্ড রয়েছে আর এতে ইঞ্জিন রয়েছে একটি।
চীনের এই বিমান তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৮৮সালে।সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ ২৯ এবং সু ২৭ কে টক্কর দেওয়ার জন্য এই বিমান তৈরির কাজ চীন হাতে নিয়েছিল!! প্রথমে চীন এই বিমানকে একটি বিশেষায়িত মিশনের জন্য তৈরি করলেও পরে একে বহুমুখী কাজের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে তুলে। যার জন্য একে মাল্টিরোল বিমান বলা হয়।
ইযরাইলের বাতিলকৃত বিমান লাভি বিমানের সাথে এর বেশ সাদৃশ্য থাকায় বিশ্বাস করা হয় গোপনে ইযরাইল এই বিমানের কিছু প্রযুক্তি চীনের নিকট বিক্রয় করা হয়েছে।তবে এই তথ্য উভয়ই দেশই অস্বীকার করেছে।পরে এই বিমানের ডিজাইণার জানিয়েছে চীনের জে ৯ বিমান হতে এই বিমান তৈরি করা হয়েছে।২০০৭ সালে সর্বপ্রথম এই বিমান আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।তবে ধারনা করা হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা চলাকালীন একটি জে ১০ বিধ্বংস্ত হয়েছিল কিন্তু বরাবরের মত এই ব্যাপারটাও চীন অস্বীকার করে।এছাড়া পাকিস্থানের এফ ১৬ হতেও চীন কিছু প্রযুুক্তি এই বিমানের জন্য গোপনে সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।এই বিমান সর্বপ্রথম আকাশে উড়ে ১৯৯৮ সালে।বর্তমানে চীন এই বিমানের পরবর্তী ভার্সন জে ১০বি তৈরি করেছে যা সার্ভিসে প্রবেশের অতি সন্নিকটে।এছাড়াও এর পরবর্তী ভার্সন জে ১০সি তৈরি করা হয়েছে।জে ১০সি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
এই বিমানের এয়ারফ্রেম তৈরি করা হয়েছে মেটাল এ্যালোয় এবং কম্পোসিট মেটারিয়েল দিয়ে যার ফলে এর ওজন কম এবং বেশ শক্তিশালী।অস্ত্রছাড়া ওজন সাড়ে নয় টনের একটু বেশি।এই বিমানের কানার্ডের অবস্থান,পিছনে লেজ না থাকার কারনে এই বিমান খুবই ম্যানুভেরাবল বিশেষ করে কম গতিতে।এই বিমানের মূল বডির নিচে রয়েছে এয়ার ইনটেক যার মাধ্যমে বাতাস ইঞ্জিনে পৌছায়।
এই বিমানের প্রথম ভার্সনে রাশিয়ার তৈরি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় ভার্সনে (জে ১০বি) নিজেদের তৈরি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।যদিও প্রথম থেকেই নিজস্ব ইঞ্জিন ব্যবহার করার কথা থাকলেও পারফরমেন্সে সন্তুষ্ট না হওয়ায় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চীনা ইঞ্জিনের নাম WS 10।এটি টার্বোফ্যান বিশিষ্ট ইঞ্জিন।এই ইঞ্জিনে FADEC রয়েছে।যার ফলে এই বিমানের ইঞ্জিন হতে কালো ধোঁয়া বের হয় না।এতে আফটারবার্নার রয়েছে।এই ইঞ্জিন সর্বোচ্চ মেক ২.২ গতি তুলতে পারে।
জে ১০এ রয়েছে গ্লাস ককপিট।এর ক্যানোপাই বাবল আকৃতির।যার সাহায্য ৩৬০ ড্রিগ্রী সবকিছু দেখতে পারবে পাইলট।ক্যানোপাই উপরের দিকে তুলে পাইলটকে সিটে বসতে হয়।এই বিমানে রয়েছে জিরো-জিরো ইজেক্টসন সিট।যার সাহায্য বিমান ভূমিতে থাকা অবস্থায় কোন গতি না থাকলেও বিপদে পড়লে ইজেক্ট করতে পারবে।
এতে ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে।এর কাজ বিমানের সবকিছু নিয়ন্ত্রন করা।এমনকি পাইলট কোন ভূল ইনপুট দিলে এটি তা সংশোধন করে দেয়।ফ্লাই বাই ওয়ার সিস্টেম রয়েছে।এই বিমানে ককপিটে রয়েছে তিনটি মাল্টিফাংশনাল ডিসপ্লে। সেই সাথে রয়েছে হেড আপ ডিসপ্লে।এছাড়া রয়েছে হেলমেট মাউন্টেড ডিসপ্লে। যার সাহায্য পাইলট যেদিকে তাকাবে টার্গেটিং কম্পিউটার সেদিকে মিসাইল তাক করাবে।
এই বিমানে রয়েছে মাল্টিমুডের ফায়ারকন্ট্রোল রাডার।এই রাডার দশটি টার্গেট ট্র্যাকিং করতে পারবে।এই দশটি টার্গেটের মধ্যে চারটিকে প্রতিহত করতে পাবে।প্রথমে এই বিমানে AESA রাডার ব্যবহার করার কথা থাকলে সময়মতো তৈরি হয় নি বিধায় এই রাডার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।তবে বি ভার্সনে AESA রাডার ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।
এই বিমানে বেশ কিছু জায়গা রেডিও ওয়েব শোষনকারী পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে যা বিমানের রাডার ক্রস সেকশন কমিয়ে দেয়।পরবর্তী প্রজন্মের ইলেকট্রনিক্সস সুট ব্যবহার করা হয়েছে।ইনফ্রারেড সার্চিং এন্ড ট্র্যাকিং রয়েছে।যার সাহায্য প্রতিপক্ষের বিমান হতে নির্গত তাপ দিয়ে বিমান ডিটেক্ট করা হয়।এতে একটা সুবিধা হলো রাডার ডিটেক্ট করার সময় রেডিয়েশন নির্গত করে যার ফলে প্রতিপক্ষ বিমানের অবস্থান জেনে যায়।কিন্তু ইনফ্রারেড সার্চিং এন্ড ট্র্যাকিং এর ক্ষেত্রে তা হয় না।এতে জ্যামিং পড ও ব্রেক প্যারাসুট রয়েছে।চীনের জে ১০ অভ্যন্তরে ৪৫০০ লিটার জ্বালানী বহন করতে পারে।তবে ধারন ক্ষমতা আরো বাড়ানো যায় ড্রপ ট্যাংঙ্ক ব্যবহার করার মাধ্যমে।
এবার আসি এর অস্ত্রের দিকে এই বিমানে মোট ১১ টি হার্ডপয়েন্ট আছে।এই সব হার্ডপয়েন্টে এয়ার টু এয়ার মিসাইল,এন্টি শিপ মিসাইল,লেজার গাইডেড বোম,ক্রুজ মিসাইল,এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল বহন করতে পারে।ভিন্ন ধরনের মিসাইল বহন করতে পারায় একে সব ধরনের মিশনের জন্য ব্যবহার করা যায়।মোট ৬ টনের মত অস্ত্র বহন করতে পারে। একটি ২৩ মিঃমিঃ এর দুই ব্যারেলের গান আছে।আনগাইডেড রকেট পড বহন করতে পারে। এছাড়া ড্রপ ট্যাংঙ্ক বহন করতে পারে। সর্বোচ্চ তিনটি ড্রপ ট্যাংঙ্ক ব্যবহার করা যাবে।আকাশে থাকা অবস্থায় জ্বালানী নিতে পারবে।
অস্ত্র নিয়ে এর রেঞ্জ মাত্র ৫৫০ কিঃমিঃ।যা এই বিমানের একটি অসুবিধা বটে।১৮ কিঃমিঃ উচ্চতায় যেতে পারবে।তবে অস্ত্রছাড়া এর রেঞ্জ ১৮৫০ কিঃমিঃ।
এই বিমানের বেশ কিছু ভার্সন আছে।এর মধ্যে প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য রয়েছে জে ১০এস যা দুই সিটের।বাকি এ এবং বি ভার্সন একসিটের।
পাকিস্তান এই বিমানের প্রথম ক্রেতা হবে বলে মনে করা হয়েছিল।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রয় করতে পারে নি।শোনা যায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এই বিমান ক্রয় করার জন্য পরীক্ষা করেছিল।কিন্তু সন্তুষ্টজনক পারফরমেন্স না হওয়ায় বাতিল করে দেওয়া হয়।তবে এই ব্যাপারটি পুরোপুরি নিশ্চিত নই।নতুন করে শুনা যাচ্ছে জে-১০ মাল্টিরোল ফাইটারের আপগ্রেড ভার্সন জে – ১০ বি কেনা হতে পারে সেটি সেমি স্টিলথ প্রযুক্তি সম্পন্ন।
যাই হোক এই বিমানকে মার্কিন এফ ১৬ এর সমতুল্য বলে মনে করা হয়।চীন এই বিমানের উপর ভিত্তি করে সামনে আরোও এডভাসন্ড বিমান তৈরি করবে।যার জন্য চীন ব্যাপক পরিমানে এই বিমান সংগ্রহ করবে না বলে মনে করা হয়।
কয়েক দশকে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করেছে চীন। মার্কিন গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর, অর্থাৎ উৎপাদনশিল্পে চীন সারা পৃথিবীর ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা থেকেই এই এগিয়ে যাওয়ার শুরু। কম খরচে এবং ভালো পরিকাঠামোতে উৎপাদনের আকর্ষণে সারা পৃথিবীর তাবৎ কম্পানির গন্তব্য এখন চীন। তাতে কম্পানিগুলোর মুনাফা হলেও চীনের কাছে চলে যাচ্ছে প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়েই এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্রের অধিকারী হয়ে গেছে চীন।