আন্তর্জাতিক বাজারে রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) বা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামকে অনেকটা পিছনে ফেলে আবারো দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আসলে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশ দুটির তৈরি পোশাক রপ্তানি পরিমাণ এবং তার আর্থিক মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, করোনা মহামারির বৈশ্বিক মহামন্দা কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ চলতি ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি থেকে জুলাই) আন্তর্জাতিক বাজারে মোট ১,৮৮০ কোটি ডলার বা ১৮.৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ঠিক একই সময়ে ভিয়েতনাম বিশ্ব বাজারে পোশাক রপ্তানি করে ১৬.৮৬ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা বাংলাদেশের চেয়ে ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার কম ছিল। তবে বরাবরের মতই বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে রেড জায়ান্ট চীন। ২০২০ সালে চীন বিশ্ব বাজারে মোট ১৩৭.৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে।
বিশ্বের উদীয়মান এবং সম্ভবনাময় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের সাথে বাংলাদেশের প্রবল প্রতিযোগিতা থাকলেও বৈশ্বিক বাজের দেশ দুটির মোট রপ্তানিতে রয়ে গেছে পাহাড় সমান পার্থক্য। ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভিয়েতনাম ২৯ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করলেও তাদের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল কিন্তু অবিশ্বাস্যাবে ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর মোট রপ্তানির বিচারে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানির অবদান মাত্র ৮.৩৩%। এদিকে আবার মোট রপ্তানির বিচারে বাংলাদেশ কিন্তু বর্তমানে ভিয়েতনামের অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। ভিয়েতনামের মোট রপ্তানির আকার কিন্তু বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় থেকে দশ গুণ বেশি। যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশর মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৮.৭৬ বিলিয়ন ডলারের।
চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ পোশাক আমদানিকারক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৬.৮১% এবং ভিয়েতনামের বেড়েছে ২০.৪৫%, ভারতের ৩২.২৮%, পাকিস্তানের ৬৬.০৯% এবং চিনের বেড়েছে ২৬.৭৭%। শতাংশ। তবে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত এবং পাকিস্তানের পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কম ছিল।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৩,৮৭৬ কোটি ডলার বা ৩৮.৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে। আবার ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ৪,৩৫০ কোটি ডলার বা ৪৩.৫ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তাছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৩,১৪৫.৬৭ কোটি ডলার বা ৩১.৪৫৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে সারা বিশ্বে। আর শতকরার হিসেবে মোট রপ্তানির বিচারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির হার ৮১.১৬% এবং অন্যান্য সকল খাত মিলিয়ে রপ্তানির হার বা অবদান মাত্র ১৮.৮৪%।
বর্তমানে বৈশ্বিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভিয়েতনামকে বিবেচনা করে থাকি আমরা। তবে ভিয়েতনামের মোট রপ্তানির সাথে আমাদের মোট রপ্তানির পাহাড় সমান ব্যাবধানের বিষয়টিকে আমরা যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকি। ২০২১ মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি আমাদের থেকে কিছুটা কম হলেও তাদের মোট রপ্তানির পরিমাণ ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং যার আশেপাশেও যাওয়ার যোগ্যতা আপাতত আমাদের নেই। এমনকি আমাদের পাশ্ববর্তী বন্ধুদেশ ভারতের মোট রপ্তানিও কিন্তু ভিয়েতনামের থেকে কম। ইউকিপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে ভারত মোট ৩১৪.৩১ বিলিয়ন ডলারের পন্য সারা বিশ্বের রপ্তানি করেছে। যেখানে ভারতের চীর প্রতিদ্বন্দী চিনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২,৬০০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কিন্তু মোট রপ্তানির সিংহভাগ ৮১.১৬% এবং অন্যান্য সকল খাত মিলিয়ে রপ্তানিতে অবদান মাত্র ১৮.৮৪%। আবার আমরা প্রতি বছর যা রপ্তানি করি তার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, মুলধনী যন্ত্রপাতি এবং সাজ সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করে তার চাহিদা মেটাতে হয়। এতে করে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫০% পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যয় হয়ে যায় এসব আমদানি করতে। যা কিনা আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অতি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা হিসেবে থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে মাত্র নিদিষ্ট কয়েকটি রপ্তানি খাতের উপর অতি মাত্রায় নির্ভর করায়, ভবিষ্যতে যে কোন কারণে এই খাত ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাত এবং অর্থনীতি মারাত্বকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে দেশের সুষম অর্থনৈতিক বিকাশে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বৈচিত্রপূর্ণ এবং যতটা সম্ভব দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর বিভিন্ন ধরণের রপ্তানিমুখী শিল্পখাত গড়ে তুলতে কাজ করে যেতে হবে।
Sherazur Rahman