খাদ্যাভাসে কচুরিপানা যুক্ত করা যায় কিনা মূলত তা নিয়ে গবেষকদের কাছে জানতে চেয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। অথচ বেশিরভাগ নিউজ পোর্টালেই তার বক্তব্যের আংশিক প্রচার করে হাস্যরস করা হচ্ছে। সামান্য কয়েকটা লাইক কমেন্ট কিংবা ভিউ এর আশায় হেড লাইন থেকে শুরু করে মূল লেখাকেও পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই সাংবাদিকদের যোগ্যতা আসলে কতটুকু? অর্থের বিনিময়ে এই পেশায় স্থান করে নেয়া লোকবল নয়তো তারা? দেশের একজন মন্ত্রীর যৌক্তিক কথাকে কাটসাট করে প্রকাশের এতোটুকু স্বাধীনরা তারা পায় কোথায়?
কচুরিপানা খেতে বলেছেন মন্ত্রী, এমন হাস্যরসের খোরাক কি আর সহজে ছেড়ে দেয়া যায়? আগ্রহ নিয়ে মন্ত্রী সাহেবের কনফারেন্সের ভিডিওটি দেখলাম। পাঁচ মিনিটের ভিডিওটি পরপর দুইবার কম্পাইল করে দশ মিনিটের ভিডিও বানিয়েছে সময় টিভি, যার চার মিনিটের দিকে তিনি কচুরিপানা খাওয়ার কথা বলেছেন। তার আগে পরে কী বলেছেন আমরা কি জানি? না জানি না। কারণ, আমরা কচুরিপানা নিয়ে ট্রল করতেই ব্যস্ত হয়ে গেছি।
সেই কনফারেন্সে মন্ত্রী সাহেব বাংলাদেশের কৃষি রুপান্তর নিয়ে বহু কথাই বলেছেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রুপান্তর কৃষিতেই হয়েছে উল্লেখপূর্বক নিজেকে গ্রামের ছেলে এবং কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, একটা সময় গ্রাম বাংলায় মৌসুমের প্রথম কাঁঠাল খাওয়াটাও উৎসবের মতো ছিলো। সেই বড় বড় কাঁঠালের মান ঠিক রেখে সাইজে ছোট করার কথাও বলেছেন।
এই কচুরিপানা পরিস্কার করা যে কী পরিমাণ পরিশ্রমের কাজ সেটা এই শহুরে মানুষ আমরা হয়তো সহজে বুঝবো না। ট্রল করে উড়িয়ে দেবো। এ কারণেই পরিকল্পনামন্ত্রী কৃষিবিদদের গবেষণা কাজে লাগিয়ে কচুরিপানা প্রক্রিয়াজাত করার কথা বলেছেন। সেই কথাচ্ছলে হাস্যরস করতে গিয়ে কচুরিপানা খেয়ে ফেলার কথা বলেছেন। এখানে উল্লেখ্য, জাপান-কোরিয়ার মত উন্নত দেশে ‘সিউইড’ মানে সামুদ্রিক শ্যাওলা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এটিও সম্ভব হয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলেই।
আমরাও কেমন একটা আজব জাতি। সব কিছুকেই আমরা হাসি তামাশার বিষয় ধরে হাস্যরসে মত্ত হয়ে উঠি। এটা কখনো আমরা ভাবিনা কথাটার যৌক্তিকতা কোথায়? দিনে দিনে একটা মানষিক বিকারগ্রস্ত জাতিতে আমরা পরিণত হচ্ছি। তার স্পস্ট উদাহরণ হলো মানুষের মৃত্যুতেও আমরা হাস্যরস খুঁজি। কখনো কি ভেবে দেখেছি সত্যিই দুর্ভিক্ষ হলে আমরা কোন কোন খাদ্যকে ব্যবহার করতে পারবো? সুসময়ের সাথে ভবিষ্যৎ এর দুঃসময় নিয়েও যে মন্ত্রী পূর্বেই ভাবতে পারে, এমন বিচক্ষণ মন্ত্রীকে তামাশার পাত্র বানিয়ে দিতে একটু মনে বাঁধলো না?
শাপলা তো কচুরি পানার মতই জলজ উদ্ভিদ। শাপলা তো বাংগালীর প্রিয় খাবার। গ্রামে অনেকেই কচুরিপানার ফুলের বড়া বানিয়ে খায়। শাপলা খাওয়া গেলে কচুরিপানা ও খাওয়া যেতে পারে। গরু কিন্তু শাপলা ও খায়, কাঠালও খায়, লাউ ও খায়। মানুষও খায়, তা বলে কি মানুষ গরু? মানুষ গরুর মাংস খায়, আবার কুকুর ও খায়, তাহলে মানুষ কি কুকুর?
গবেষনার জগত অসীম, উম্মুক্ত এবং প্রচন্ড সম্ভাবনাময়। পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে উনি গবেষকদের সাথে কথা বলছিলেন নতুন আইডিয়া নিয়ে এবং উনি সঠিক ও দুরদর্শী চিন্তা করেই কথাটা বলেছেন। চিন্তা করেন এখন আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটি, আগামি ১৫ বছর পর কত হবে? কৃষি জমি কমে যাচ্ছে, সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে , সুতরাং আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের গবেষনা করে কাজে লাগাতে হবে ।
কচুরিপানার পাতা থেকে অক্সালেট যৌগটুকু দূর করতে পারলেই মানুষের খাওয়ার উপযোগী করা সম্ভব। তাই গাধার মতো না বুঝে হাসবেন না, কারণ বিজ্ঞানের রাজ্য অসীম কোথায় কী আছে তা কেবল গবেষণা সাপেক্ষ । কচুরিপানার ফুল কিন্তু মানুষ খায়, এটা জানা আছে?
মন্ত্রীকে তো ট্রল বা কোট করা শুরু করলেন! Genetical modified(GM) technique ব্যবহার করে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের আমুল পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে, আর সেখানে কচুরিপানাকে Human consumptive food হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা গবেষণায় হয়তো মোটেও হাস্যকর নয়।
ট্রল করার আগে আলোচ্য কথাগুলো বলা মানুষটি সম্পর্কে আগে জেনে নিই। বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ছিলেন সাবেক সিএসপি কর্মকর্তা। আমাদের ক্যাবিনেটে এমন একজন বিজ্ঞ লোক আছে সেটা হয়তো আমরা জানিই না। আমরা জানি শুধু ট্রল করতে। আমাদের মন্ত্রী মিনিস্টারেরা নিয়মিতই বেফাঁস মন্তব্য করে সমালোচিত হয়ে থাকেন। আমরা হয়তো অপেক্ষাতেই থাকি কে কখন কী বলবে আর আমরাও শুরু করে দেবো পচানো। অথচ কে কোন সেন্সে কী বলছে সেটার ব্যাপারে জানার আগ্রহ নেই কারোই।
লেখকঃ তানভীর হাসান, সম্পাদক – সাম্প্রতিক সংবাদ