বিভাগ সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর জানাজায় কেন মাত্র ৩৫ জন উপস্থিত ছিলো? সকল বিভ্রান্তির জবাব

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

কেন বঙ্গবন্ধুর জানাজায় মাত্র ৩৫ জন লোক উপস্থিত ছিল?
‘বঙ্গবন্ধু যদি এতই জনপ্রিয় হয়ে থাকেন, কেন তার জানাজায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হলো না? কেন মাত্র ৩০-৩৫ জন উপস্থিত ছিল?’- অনেকেই আবার ইতিহাসচর্চার অভাবে সঠিক কারণ সত্যিকারার্থেই জানতে পারেন না। এর উত্তর পেতে হলে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গোসল-দাফন; জানতে হবে পুরো ঘটনাক্রম।ভোর পাঁচটা চল্লিশ। বত্রিশ নম্বরের বাড়িটির প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা, তার তিন-চার ধাপ ওপরে একেবারে কাছ থেকে গুলিতে শেখ মুজিবের নিথর দেহ পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে তাকে খুন করা হয়েছে। পরনে ছিল চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস ভাঙা। রক্তে পাঞ্জাবির রং হয়ে গিয়েছে গাঢ় লাল। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। তার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। প্রিয় তামাকের পাইপটি সিঁড়িতে পড়ে আছে। একটি বুলেট তাঁর ডান হাতের তর্জনীতে গিয়ে লেগেছিল। আঙুলটি প্রায় বিচ্ছিন্ন। এই আঙ্গুল দিয়েই তো কতশতবার বজ্রকন্ঠে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন পাকিস্থানিদের বিরুদ্ধে।


পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের এমন ভয়াল বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। তার বর্ণনায় তিনি ব্যক্ত করেন এইভাবে-
কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমত রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ।

১৬ই আগস্ট, ১৯৭৫


রেডিওতে প্রচারিত খবর শুনে গ্রামবাসী আগেই জেনে গিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর। পুরো গ্রাম শোকে বিহ্বল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি হবে হবে এমন অবস্থা। লাশ নামানো হচ্ছে হেলিকপ্টার থেকে। হেলিকপ্টারের পাখার আওয়াজ ছাপিয়েও আরেকটি আওয়াজ বাতাসে ভাসছে। টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ মানুষের বিলাপের ধ্বনি। এরা দেখেছে এই টুঙ্গিপাড়াতে বঙ্গবন্ধুর শৈশব, তার বেড়ে ওঠা, তাকে দৌড়াতে দেখেছে বিস্তৃত ধানক্ষেতের মাঠে, ছুটে যেতে দেখেছে মানুষের দুঃখে, দেখেছে মিছিলে, মিটিংয়ে। সেই মানুষটা আজ নিজ গ্রাম এসেছে। অথচ, বুক তার বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে আছে, দেহটা তার নিস্তব্ধ।

হেলিকপ্টারের থেকে লাশ নামানো হলো। গোপালগঞ্জ পুলিশের লোকজন চারদিক ঘেরাও করে রেখেছে। কেউ যেন লাশের কাছে না আসতে পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা। লাশটাকে নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। শৈশবে যে উঠানে তার হাঁটতে শেখা, সে উঠানে রাখা হলো নিশ্চল রক্তেভেজা শেখ মুজিবের কফিন।
দাফনকাফনে অংশ নিতে বাধা দেয়া

অনেকে লাশ দেখতে আসতে চাইলেন। ভয়ে ভয়ে দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা এগিয়ে আসলেন। গ্রামবাসীরাও তাদের প্রিয় নেতাকে, প্রিয় মানুষটাকে শেষবারের মতো দেখতে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ ও সেনাবাহিনী চায় না কেউ লাশের কাছে আসুক। তারা বাধা দিলো। কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়া হলো না। শুধু ১৫/১৬ জনের মতো মানুষকে রাখা হয় তার কফিন বহন করার জন্য। কফিনের ভেতরে বড় বড় বরফের টুকরা, খুবই ভারী, এখানে তো কিছু মানুষ লাগবেই!
কফিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আনার পর, কফিন খোলা নিয়েও ঝামেলা দেখা দেয়। এমনভাবে কফিনটা লাগানো হয়েছিলো যে, পরে সেটা খুলতে মিস্ত্রী পর্যন্ত আনতে হয়েছিল। ওই সময়টায় সেনারা কফিনসহ বঙ্গবন্ধুকে কবর দিতে চাইলো। তারা ঝামেলা এড়িয়ে জানাজা না করেই দ্রুত দাফনের কাজ শেষ করতে চায়। রজব আলী, যিনি পঁচাত্তরে রেডক্রস অফিসে পিয়নের চাকরি করতেন তিনি প্রতিবাদ জানান।

১৬ আগস্ট হেলিকপ্টারে মিয়া ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) টুঙ্গিপাড়ায় আনা হয়। কবর খোঁড়া, লাশ দাফনের জন্য লোকের প্রয়োজন হয়। আমি এগিয়ে যাই। কবর খুঁড়ি। লাশের সঙ্গে আসা মিলিটারিরা মিয়া ভাইকে মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি প্রতিবাদ জানাই। তাদের বলি, মিয়া ভাইকে ইসলামী বিধিবিধান মতো দাফন-কাফন করতে হবে। তৈয়ব মাতুব্বরের দোকান থেকে ৫৭০ সাবান কিনে আনি। সেই সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানো হয়।
৫৭০ সাবান দিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি, সর্বকালের সেরা বাঙ্গালীর লাশের গোসল করানো হলো। তারপর রেডক্রসের রিলিফের শাড়ি যা কিনা কিছুদিন আগে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই বিতরণ করেছিলেন, তা ছিঁড়ে তৈরিকৃত কফিনের কাপড় দিয়ে লাশ জড়ানো হলো। জানাজা পড়ালেন মৌলভী সাহেব। সেনা অফিসার ও জোয়ানেরা জানাজায় অংশ নিলেন না। রাষ্ট্রনায়ককে সম্মান জানাতে বিউগলের করুণ সুরও বাজলো না। কিন্তু টুঙ্গীপাড়ার গ্রামবাসীর চাপা কান্না এক শোকবিহ্বল পরিবেশের সৃষ্টি করলো।

সেনাদের ভয়


সেদিন মানুষ যেমন আর্মিদের ভয় পাচ্ছিল, আর্মিরাও ভয় পাচ্ছিল সাধারণ মানুষদের, কখন জানি তারা ক্ষেপে ওঠে! আর্মিরা যে ভয় পাচ্ছিল সেটা বুঝতে পারা যায়, কর্ণেল কাজী হায়দার আলীর বক্তব্য থেকে। তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন-
“হেলিকপ্টারের মধ্যে কারো মুখে কথা নাই, সবাই হয়তো আমার মতোই ভাবছিল, এই কঠিন দায়িত্বে আল্লাহ কেন আমাদের সোপর্দ করলেন? দায়িত্ব পালন করে নিজেরা ফিরতে পারবো কি? দেশের প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে যাচ্ছে, লোকেরা কত কিছু জিজ্ঞাসা করবে, তার জবাব কী দেব? সবাই মনে করবে আমরাই এই অঘটন ঘটিয়েছি, তখন লোকাল এরিয়া থেকে পাল্টা আঘাত আসতে পারে, নিজেরা সামলে ফিরে আসতে পারবো কি?”

এই ভয়ের কারণেই, সেদিন, বঙ্গবন্ধুর জানাজায় সামিল হতে দেয়া হয়নি সাধারণ মানুষকে। অথচ, ঘাতকরা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিলো যে বঙ্গবন্ধুর জানাজায় কেউ অংশ নেয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা


বঙ্গবন্ধুর কবর খুঁড়েছিলেন আব্দুল মান্নান শেখ। গোসলও করিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন,
বুকে ছিল তার চব্বিশটি গুলি। ডান হাতের তালুতে একটি। বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি। দুই রানের মধ্যখানে দুইটি গুলি। গোসলের আগে তার গায়ের গেঞ্জি, পাঞ্জাবী, প্লেকার্ড লুঙ্গি, পাঞ্জাবীর পকেটে রুমাল, তামাকের কৌটা, পাইপ, একটি তোয়াইলা, একটি চাদর, এগুলি পাওয়া যায়। জিনিসগুলি ধুয়ে যত্ন কইরা রাখি। ধুইতে গিয়া খালি গেঞ্জিটা হারাইয়া ফেলি।
বঙ্গবন্ধুর খেলার সাথী, নিকটতম প্রতিবেশী কৃষক আব্দুল মান্নাফও বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়ে ইসলামী বিধিবিধান মতো সমাধিস্থ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৩ সালের ২৫ এপ্রিল ৮৪ বছর বয়সে তিনি শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মারা যান। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত শরীর দেখে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।’

কবর দেয়ার পর


বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিলো। তাকে দাফনে অংশ নিতে এগিয়ে আসা গ্রামের মানুষরা কেউই অংশ নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর গোসল, জানাজা ও দাফনে টুঙ্গিপাড়া, পাঁচকাহনিয়া ও পাটগাতী গ্রামের ৩০-৩৫ জন অংশ নিয়েছিলেন। কবর দেওয়ার পর পর সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কবরের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না। দাফনের পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত বা শ্রদ্ধা নিবেদন নিষিদ্ধ ছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরই সারাদেশে কারফিউ জারি ছিলো। ১৭ আগস্টের পত্রিকা বলছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়নগঞ্জ বাদে বাকি দেশে কয়েকঘন্টার জন্য তা শিথিল করা হয়েছে। এই কারফিউ জারি ছিলো ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। যারা মুজিব হত্যার পর রাস্তায় লোক নামে নাই কেনো প্রশ্ন তোলেন কেনো তার জানাজায় মানুষ হয় নাই জানতে চান- তারা নিশ্চয়ই এর মাঝেই জবাব খুজে পাবেন। কারণ কারফিউতে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল, যা বারবার রেডিও টিভিতে প্রচার হচ্ছিলো।

এরপর পুরো দুই দশক তার নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। না রেডিও, না টেলিভিশন, নাসংবাদপত্র- কোথাও ছিলেন না তিনি। শুনেছি, ১৫ আগস্ট এলে নাকি তখন টিভিতে বলা হতো, খবরের এক কোণে, “আজ মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী”! হায়, তিনি কি শুধুই ছিলেন একজন রাষ্ট্রপতি!

পাকিস্থানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার সাহস করতে পারেনি ঠিকই। অথচ, কি নির্মম পরিহাস, কি দুঃখের কথা যে নিজ দেশে, নিজ মাটিতে, নিজ বাসভবনেই বঙ্গবন্ধুকে নিহত হতে হয়েছিলো। এতটা বিশ্বাস যাদের উপর করে জীবনটা পার করে দিয়েছেন, যে জাতির জন্যে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কারাগারে বসে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন, যে জাতিকে ভাষা দিলেন, অধিকার আদায়ের দীক্ষা দিলেন, সংগ্রাম করার শিক্ষা দিলেন, স্বাধীনতার স্বাদ দিলেন- সেই মানুষটাকে আমরা মেরে ফেলেছি! মৃত্যুর সময়ও চরম অবিশ্বাস নিয়ে মরেছেন লোকটা এই ভেবে, আমার দেশের মানুষ আমাকে মারতে পারলো!

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored