সাম্প্রতিক শিরোনাম

সংকটে মার্কেটিং-৮/২

চাহিদা ব্যবস্থাপনা
(৩) শূন্য চাহিদা (No Demand): কেউ যদি এমন পণ্য বাজারে নিয়ে আসে যা একেবারেই অভিনব, জীবনে কেউ এর নামও শুনেনি, দেখেওনি এবং পণ্যটি ব্যবহারের সাথে কিছুটা হলেও ঝুঁকি জড়িত আছে তখন এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে শূন্য চাহিদার পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ব্লক সুপারভাইজাররা যখন নতুন কোন চাষ পদ্ধতি বা নতুন কোন জাতের বীজ নিয়ে কৃষকের কাছে যায় তখন তাদের এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। নতুন জাতের লাউয়ের বীজ, প্রতি পাতার গোড়ায় লাউ ধরবে; ১০টা বীজ মাত্র এক টাকা দাম। তাও কৃষকরা নিবে না, কারণ তাদের ভয় নতুন জাতের লাউ গাছে যদি লাউ না ধরে। কৃষি বিভাগের লোকেরা তো লাউয়ের বীজ দিয়ে চলে যাবে । লাউ গাছে লাউ ধরে দুই তিন মাস পর। তখন যদি দেখা যায় লাউ ধরছে না। তাহলে কি হবে ? আগের বছরের জানাশোনা লাউয়ের বীজের উপরেই তাদের আস্থা। গত বছর লাউ ধরেছিল, এবারও ধরবে । ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। প্রকৃতপক্ষেই কখনো কখনো নতুন জাতের বীজ থেকে ফল নাও আসতে পারে। এমন অভিজ্ঞতা দুই একবার যে কৃষকের হয়নি তাও নয়।

*গ্রামের বাড়িতে আমার পড়ার ঘরের সামনে ছোট একটা ফুলের বাগান ছিল। ১৯৭৬ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকায় চলে এলাম বাগানটির যত্ন করার মতো কেউ ছিলনা। এক বৃষ্টির দিনে আব্বা কোথা থেকে যেন একটা লাউয়ের চারা এনে বাগানের এক পাশে লাগিয়ে দিল। বাগানের বাইরে যে খালি জায়গাটুকু আছে সেদিকে গাছটি সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু দেখা গেল আমার বাগানের দিকেই লাউ গাছটির বাড়ার আগ্রহ। তখন ফুলের বাগানের উপরেই মাচা বানিয়ে সুযোগ করে দেয়া হলো এবং লাউ গাছটিও মনের আনন্দে আমার ক্ষয়িষ্ণু ফুলের বাগানের উপরে জায়গা করে নিতে লাগলো। বেশ কিছুদিন পর আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার ফুলের বাগানের পুরোটাই লাউ গাছ দখল করে নিয়েছে। আমার খুব রাগ হল। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল কারণ পুরো লাউ গাছটিতে একটি লাউও ধরেনি। এ নিয়ে যখন উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করতে লাগলাম, ফুল বাগানে কেন লাউ গাছ লাগানো হলো ? তাও যদি দেখতাম যে লাউ ধরেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি যতই চেঁচামেচি করছি মা তখন দূরে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন । মাকে জিজ্ঞেস করলাম হাসছেন কেন? লাউ কোথায় ? মা তখন জবাব দিলেন , “তোর আব্বা যখন লাউ গাছ লাগায় তখনই আমি বাধা দিয়েছিলাম। ফুলের বাগানের পাশে লাউ গাছ লাগালে তুই বাড়ি আসলে রাগ করবি। তোর আব্বা কিছুতেই আমার বাধা মানল না। বলল, “লাগাই, শাক-টাক খাওয়া যাবে” । আব্বা নাকি শাক খাওয়ার নিয়্যত করেই লাউ গাছ লাগিয়েছিল । অতএব গাছে শাক ধরেছে লাউ ধরেনি। (“ইন্নামাল আ’মালু বিন্নিয়াত ” –বুখারী শরীফের প্রথম হাদিস)।

আমার আব্বা না হয় শখ করে লাউ গাছ লাগিয়েছিলেন এবং শাক খেলেন। কিন্তু লাউ চাষী যদি নতুন বীজ লাগিয়ে দুই তিন মাস পরে দেখে তার কেবল শাক হচ্ছে, লাউ নেই। তখন কি হবে ? ঢাকায় তো আমরা লাউ শাক কিনে খাই, প্রতি ডগার দাম ১০টাকা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একটা সময় লাউ শাক একেবারেই বিক্রি হয় না, গরুও লাউ শাক খায় না। পেঁপের চারার ঝুঁকি আরো বেশি। দশটি পেঁপের চারা লাগালে পাঁচ ছয়টা পুরুষ পেঁপে গাছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লাউ গাছে লাউ না ধরলেও শাক খাওয়া যায়। পুরুষ পেঁপে গাছ কুঁচি কুঁচি করে কেটে মনের ক্ষোভ কমানো ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। তাই পেঁপের চারা অত সহজে বিক্রি করা যায় না। কাকরাইল এজিবি অফিসের আশেপাশে এক পেঁপের চারা বিক্রেতাকে দেখেছি একটি ভ্যান গাড়ির উপর একটি ড্রামের মধ্যে একটি বড় পেঁপে গাছ নিয়ে ঘুরতে। গাছটির গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পেঁপে ধরে আছে । ড্রামের পাশেই অনেকগুলো পেঁপের চারা রাখা আছে। সে দর্শকদের বলছে, “দেখুন এই হচ্ছে সেই চারা যা থেকে এই রকম একটি গাছ হবে , আর গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পেঁপে ধরবে। নতুন জাতের লাউ এর ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হবে । কৃষিদপ্তরকে প্রথম বছর দর্শনীয় স্থানে প্রদর্শনী খামার তৈরি করতে হবে। নতুন বীজ বপন করে কৃষকদের দেখাতে হবে পাতায় পাতায় লাউ ধরেছে। এর পরের বছর কৃষকরা নিজেরাই নতুন বীজ গ্রহণ করবে। ইদানিং প্রদর্শনী খামারের বিকল্প হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে ভিডিও প্রদর্শন করা। তবে অনেকেই আবার ভিডিওতে কারসাজি আছে বলে এটা বিশ্বাস করতে চায়না। গ্রামে-গঞ্জে প্রদর্শন ও উপস্থাপনের কোন বিকল্প নেই । আমাদের সিলেট ও আসামে ব্রিটিশরা যখন চা বাগান তৈরি করে তখন এদেশে অল্প কিছু লোকই জানতো চা কি ? কেন খায় ? কিভাবে তৈরি করতে হয় ? ইত্যাদি কিছুই জানা ছিলনা এই অঞ্চলের লোকদের। ব্রিটিশরা গাছের ডগার পাতা দিয়ে উন্নত মানের চা বানিয়ে ইউরোপ নিয়ে যাবে। কিন্তু গাছের অপেক্ষাকৃত মোটা পাতাগুলোর কি হবে? তখনই ব্রিটিশরা ভাবলো এদেশে একটা চায়ের বাজার তৈরি করতে হবে যাতে তাদের ডাস্টগুলো বিক্রি করা যায়। ব্রিটিশরা তখন যেটা করলো, বাজারে বাজারে গিয়ে আসর জমিয়ে চা বানাতে লাগলো এবং বিনামূল্যে সবাইকে চা খাওয়ালো।

আসরগুলোতে হালকা বিনোদনের জন্য দোতারা গানের ব্যবস্থা থাকতো। চা খাওয়ার পর চা দুধ চিনি প্যাকেট করে সবাইকে দিতে লাগল যাতে বাড়িতে নিয়েও চা খেতে পারে। চা একটি নেশা জাতীয় পানীয়, এই অর্থে কেউ কিছু দিন চা খেলে নেশা ধরে যাবে। না খেয়ে থাকতে পারবে না, মাথা ধরে যায়। যারাই বিনা পয়সায় চা খেল তাদের চায়ের নেশায় পেয়ে বসলো। গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ বাজারে চায়ের আসরের চার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো চা খাওয়ার জন্য এবং চায়ের উপকরণ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে যখন ভিড় সামলাতে পারল না তখন ব্রিটিশরা বলল এখানে চা খাওয়া যাবে, বাড়িতে নেয়া যাবে না। তবু ভিড় কমলো না। শুধু চা খাওয়ার জন্য মানুষ রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতো। এক পর্যায়ে ভিড় কমানোর জন্য প্রতি কাপ চা সিকি পয়সা দাম ধার্য করা হলো। (ষোল আনায় এক টাকা, ৪ সিকি পয়সায় এক আনা। সিকি পয়সার মাঝখানে একটা ছিদ্র ছিল। ছোটবেলায় এমন ছিদ্রওআলা পয়সা আমরা দেখেছি। এখন জাদুঘরে গেলে এগুলো দেখা যাবে)। সেই যে সিকি পয়সা দাম ধরা হলো, এখন এক কাপ চায়ের দাম চারশত টাকা । হোটেল রেডিসন ব্লু তে একটি বিস্কুট আর এক কাপ চা ৪৭০ টাকা, ৭০ টাকা বিস্কুটের দাম হলে চায়ের দাম ৪০০ টাকা । এটাকে বলা হয় ‘মার্কেট পেনিট্রেশন স্ট্র্যাটিজি’ (market penetration strategy) । শূন্য থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে উপরের দিকে যাওয়া। অপরদিকে নতুন পণ্য যদি এমন হয় পণ্যটি সম্পর্কে মানুষ আগে থেকেই জানে । একদল লোক যেকোনো মূল্যে পণ্যটি পেতে চায়। পণ্যটির কোন প্রতিযোগী নেই। তেমন কোনো বিকল্পও নেই । যেমনটি হয়েছিল বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশে যখন প্রথম মোবাইল ফোন আসে আশির দশকের শেষের দিকে তখন মানুষ এ সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে গেছে। যেখানে যাবেন সেখানেই মোবাইল ফোন যাবে। অসাধারন এক অনুভূতি । একদল লোক এই সুবিধার কথা শোনা মাত্রই বলতে লাগলো, ‘আমার এটা চাই, যত টাকা লাগে লাগুক মোবাইল ফোন চাই’। সুযোগটা নিল সিটিসেল। সিটিসেল কোম্পানি বর্তমানে বিলুপ্ত এবং মালিকরা পলাতক। এরশাদ সরকারের সাথে সিটিসেল চুক্তি করলো আগামী দশ বছর এদেশে অন্যকোন মোবাইল ফোন কোম্পানি আসতে পারবেনা।

১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তদানীন্তন টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রী হওয়ার পর হাইকোর্টে মামলা করে মামলায় জিতে সরকারকে গ্রামীণফোনের অনুমতি দিতে হয়েছিল। সিটিসেল কোম্পানি প্রথম দিকের প্রতিটি মোবাইল ফোন বিক্রি করেছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা করে। বিক্রি যখন একটু কমে আসলো প্রতি সেটের দাম ধরা হলো দেড় লক্ষ টাকা । এভাবেই কমতে কমতে ২৫ হাজার টাকা, দশ হাজার টাকা, ৫০০০ টাকা‌। এক পর্যায়ে বলা হল সেটের দাম নেই মাসিক বিল দিলেই চলবে । এই পদ্ধতিটাকে বলা হয় market skimming strategy বা সর তোলা কৌশল। Skimming হচ্ছে দুধের সর তোলা । দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে সর তোলা হয়। আবার জ্বাল দিয়ে আবার ঠান্ডা করে সর তুলতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর সর উঠা বন্ধ হয়ে যায়। তখন অবশিষ্ট দুধ মাঠা হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অন্য পাত্রে রাখা সর জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করা হয়। অতি উচ্চ দাম থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে হয়। বাজারে সর তোলা মূল্য কৌশল ফলপ্রসূ হয় কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে। প্রথমত, পণ্যটির উচ্চমূল্য এর মান ও ভাবমূর্তি দ্বারা সমর্থিত হতে হবে এবং এই উচ্চ মূল্যে প্রচুর সংখ্যক ক্রেতা পণ্যটি পেতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, সীমিত সংখ্যক পণ্য উৎপাদনের ব্যয় এত বেশী হবেনা যার দ্বারা উচ্চমূল্যের সুবিধাটুকু বিলীন হয়ে যাবে। সবশেষে, প্রতিযোগীর পক্ষে সহজে বাজারে প্রবেশ সম্ভব হবে না এবং উচ্চ মূল্যের বাজারকে প্রতিযোগী কম মূল্যের পণ্য দ্বারা দখল করতে পারবে না।

(৪) সুপ্ত চাহিদা (Latent Demand): মার্কেটিং সংশ্লিষ্টদের বড় একটা কাজ হচ্ছে নতুন কিছু বাজারের ছাড়া । যে পণ্য (ক্রেতার সমস্যার সমাধান ) বাজারে নেই সেই পণ্য বাজারে নিয়ে আসা । যারা নতুন করে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে চান তাদের জন্যও বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যে পণ্য বাজারে আছে তারই একটি হুবহু সংস্করণ ভিন্ন নামে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়া হলে এটা বাজারে কোন সারা জাগাতে পারে না। ভোক্তার এমন চাহিদা থাকতে পারে যা বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাওয়া কোন পণ্য দিয়েই মিটছে না অথবা পণ্যটি আছে কিন্তু ভোক্তা তথ্য অথবা অর্থের অভাবে সেটা পাচ্ছে না। ভোক্তার নিড আছে কিন্তু তাঁর আরধ্য পণ্যটি যে পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে অবগত নয় । আর্থিক কারণে যারা পণ্যটি কিনতে পারছে না তাদেরকেও এই শ্রেণীভুক্ত করা হয়। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এই সুযোগটা নিতে পারে। প্রত্যেক ভোক্তা তাঁর সমস্যার শতভাগ জুৎসই সমাধান চায়। অনেক শক্তিশালী সুপ্ত চাহিদা থাকতে পারে।

ক্যামব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী সুপ্ত চাহিদা হচ্ছে, “demand for a product or service that a consumer cannot satisfy because they do not have enough money, because the product or service is not available, or because they do not know that it is available. তিনটি কারণে ক্রেতার মনে এ ধরনের পণ্যের সুপ্ত চাহিদা থাকে:
১. ভোক্তার কাছে পণ্যটি ক্রয় করার মতো অর্থ নেই
২. পণ্যটি বাজারে নেই
৩. পণ্যটি বাজারে আছে ভোক্তার কাছে কোন তথ্য নেই
এছাড়াও ভোক্তার কিছু একটা প্রয়োজন কিন্তু সেই প্রয়োজনটা যে কি সে সবসময় সুস্পষ্ট করে বলতে পারে না। তবে অন্য কেউ বলে দিলে এমন পণ্যটি পাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে সেটাও সুপ্ত চাহিদার অন্তর্গত। বর্ষার সিজনে বড় একটা সমস্যা হচ্ছে সন্ধ্যার দিকে গরম লাগে, রাতে বৃষ্টি হলে ভোর বেলায় অনেক ঠান্ডা লাগে। যারা রাতে ঘুমানোর সময় জোরে ফ্যান চালিয়ে ঘুমান ভোর বেলায় তাঁরা শীত অনুভব করে । ফ্যানের বাতাস খুব ঠান্ডা লাগায় ফ্যানটি বন্ধ করতে চায়। বন্ধ করতে হলে সুইচ টিপতে হয়, সেটা বেড সুইচ হলেও। অথবা আজকাল রিমোট কন্ট্রোল পাখা বাজারে পাওয়া যায় যা দিয়ে পাখার গতি কমানো এবং বাড়ানো যায়, বন্ধ করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভোর রাত্রে অঘোর ঘুমের মধ্যে রিমোট টিপবে কে ? যদি থার্মোস্ট্যাট যুক্ত একটি পাখার ব্যবস্থা করা যেত যা ঘরের তাপমাত্রা অনুযায়ী পাখাকে ঘুরাবে অর্থাৎ তাপমাত্রা বেশি হলে পাখা জোরে ঘুরবে, তাপমাত্রা কমে গেলে পাখার ঘুরার গতি নিজেই শ্লথ হয়ে যাবে এবং ঘরের তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট মাত্রা কমে চলে গেলে পাখা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।

এই থার্মোস্টেটটি লাগাতে পাখা প্রতি মাত্র ২০০ টাকা খরচ হবে। এই ডিভাইসের কথা যদি কেউ শোনে, যে কোনদিন এটা কল্পনাও করে নাই, সেও বলে বসবে আমার অবশ্যই এটা লাগবে। এটাই সুপ্ত চাহিদার একটি উদাহরণ। আমি সব সময় ভাবি যদি চর্বিযুক্ত খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানীর পাওয়া যেত যেটা কোলেস্টেরলমুক্ত হবে, তাহলে নিয়মিত কাচ্চি বিরিয়ানী খেতাম। অনেকে বলে নিকোটিন বিহীন সিগারেট যদি থাকতো। ইদানীংকালে অনেকে বলছে ঘরে যদি অক্সিজেন ফ্লো অব্যাহত রাখার মত কম খরচে একটি স্বয়ংক্রিয় অক্সিজেন মেশিন থাকতো, ইত্যাদি । বহু কিছু মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং মনে মনে খুঁজছে বাজারজাতকরনকারীর কাজ হচ্ছে এ ধরনের পণ্যের বাজারের আয়তন নিরূপণ করা এবং জুৎসই পণ্য উন্নয়ন করা যা দিয়ে মানুষ অতৃপ্ত চাহিদা পরিতৃপ্ত করবে। নতুন পণ্য দুই প্রকার ইনোভেটিভ(innovative) এবং ইমিটেটিভ(imitative)। ইনোভেশন জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। অনেক কোম্পানিতে এজন্য R&D বিভাগ থাকে তাঁরা অনবরত উন্নয়নের কাজটি করে। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য বেশি সহায়ক হতে পারে ভোক্তাদের ব্যবহৃত বর্তমান পণ্যগুলির সমস্যা খুঁজে বের করা।

প্রশ্ন করলেই দেখা যাবে তাঁদের বাড়িতে এবং অফিসে অনেক পণ্য-সেবা-মেশিন ব্যবহার করে যেগুলোতে কোন না কোন ত্রুটি আছে। শতভাগ নিশ্চিত ফলাফলের জন্য এগুলোতে সংশোধন আনা প্রয়োজন। ব্যবহারকারীরা সংশোধনী নিয়ে জ্ঞান রাখে কিন্তু প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে সেটা তাঁরা করতে পারে না। যা কেবল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব। আমরা যত গৃহস্থালী পণ্য বা যন্ত্র ব্যবহার করি ব্যবহারের কয়েকদিনের মধ্যেই পণ্যটির সীমাবদ্ধতা টের পেয়ে যাই । একবার খুব পছন্দ করে বাথরুমে ব্যবহার করার জন্য একটি মগ কিনে নিয়ে আসলাম, কিন্তু ব্যবহার করতে গিয়ে দেখলাম মগটির হাতল ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে মগের সাথে ফিক্সড করা। এটা রাখার জন্য বাথরুমের জায়গা পাচ্ছিলাম না । বেসিনে রাখলে হাত লেগে বারবার নিচে পড়ে যায়। বালতির ভিতর রাখলে শ্যাওলা ধরে যায়। তখনই আমার মনে হলো যদি মগটি বালতির সাথে ঝুলিয়ে রাখা যেত, কিন্তু এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। কেবলমাত্র মগ উৎপাদনকারী প্লাস্টিক কোম্পানিই সেটা করতে পারে। গোসলের সাবানগুলোর বড় একটা সমস্যা হচ্ছে প্রথম দুই তিন দিন এগুলো খুব পিচ্ছিল থাকে। যার কারণে গায়ে মাখার সময় হাত থেকে ফসকে যায়। আর গোসল করার সময় হাত থেকে সাবান ফসকে গেলে বিশেষ করে সেটা যদি নতুন সাবান হয় অবধারিতভাবেই সেটা কমোডে গিয়ে পড়বে।

সাবান হারানো ছাড়াও এতে আরো নতুন সমস্যা দেখা দেয়। সাবানের পিচ্ছিল ভাব প্রথম দুই তিন দিন থাকলেও পরে সেটা ড্রাই হয়ে কেটে যায়। অতএব সাবানে যদি খাঁজ কেটে দেয়া হয় অথবা সাবান যদি একটু বাঁকা করে দেয়া যায় তা সহজে হাত থেকে পড়বে না। সাবান হারানো এবং কমোডে সাবান পড়ার কারণে সৃষ্ট জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ ধরনের ব্যবহার্য পণ্যগুলোতে প্রত্যেকটিতেই সমস্যা আছে। ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করলেই ইমিটেটিভ প্রোডাক্ট এর ধারনা পেতে কোন অসুবিধা হবে না। ভোক্তাদের অংশগ্রহণে ফোকাস গ্রুপ আলোচনা এবং in-depth ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে। সম্ভাব্য বাজারটি পরিমাপ করে সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হবে। ভোক্তারা যেন পণ্যটির জন্য ব্যয় করতে তাড়িত হয় সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর্থিক সমস্যার ব্যাপারে কিস্তিতে অথবা বিলম্বে মূল্য পরিশোধের সুযোগ রাখা যেতে। যারা নতুন করে স্টার্টআপ করতে চাচ্ছেন এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এই পরামর্শ কাজে আসতে পারে। এক্ষেত্রে পণ্য মান এবং মূল্যের ভিত্তিতে চারটি কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথম কৌশলটি হচ্ছে “প্রিমিয়াম কৌশল”। বিদ্যমান পণ্যের সাথে অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য যোগ করে মান উন্নত করা এবং দাম বাড়িয়ে দেওয়া। অনেকটা “জিনিস যেমন দামও তেমন”। ঢাকা শহরে কিছু কিছু মিষ্টি বিক্রেতা প্রিমিয়াম কৌশল গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছে।

সনাতন মিষ্টির ধারণাটি তাঁরা বদলে দিয়েছে। ভোক্তারা মিষ্টি খেলেই বুঝতে পারে এটি আগের কোন মিষ্টির মত নয়। অত্যন্ত উন্নতমানের, অতএব বেশি দাম দিতে তাঁদের আপত্তি থাকে না । তবে মন্দা অর্থনীতির সময় এই কৌশলটি তেমন কাজে আসবে না। দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে পণ্যের মান বাড়িয়ে দাম কমিয়ে দেওয়া “গুড-ভ্যালু” কৌশল। এক্ষেত্রে সমস্যাটা হবে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা ভালো জিনিসের দাম বেশি হয় কিন্তু এক্ষেত্রে দাবি করা হচ্ছে ভালো জিনিসের দাম কমে গেছে । এই বিষয়টি তাদের যদি ভালো করে বোঝানো যায় তাহলে সফলতা পাওয়া যেতে পারে। জিনিসটি ভালো বলেই বাজারে বেশি চলছে যার কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার উৎপাদন ক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করতে পারছে। উৎপাদন ক্ষমতা শতভাগ ব্যবহার করার কারণে একক প্রতি উৎপাদন খরচ কমে গেছে অতএব মূল্য কম রাখা গেছে। তাছাড়া পণ্যটি ক্রেতারা টেষ্ট করে যদি দেখে যে সত্যি সত্যি পণ্যের মান বেড়ে গেছে তাহলে কম দামের ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহ থাকবে না । আরেকটি কৌশল হচ্ছে “ওভার চার্জিং”স্ট্র্যাটিজি। আমি এটার নাম দিয়েছিলাম “গলাকাটা” কৌশল। পণ্য থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য সরিয়ে ফেলে আরো সাদামাটা করে উচ্চ মূল্য ধার্য করা। সারা পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক ক্রেতা আছে তাদের ধারণা যে পণ্যের দাম যত বেশি সেটাই সবচেয়ে ভালো পণ্য। আবার কিছু লোক মনে করে উচ্চ মূল্যের পণ্য সবাই কিনতে পারবে না ।

সে উচ্চমূল্য দিয়ে পণ্যটি কিনে মর্যাদাবান হবে। সে একাই পণ্যটি কিনেছে, আশেপাশে কেউ কিনতে পারছে না উচ্চ মূল্যের কারণে, এটাই তাঁর আনন্দ। কোরবানির সময় সর্বোচ্চ দামে বাজারের সবচেয়ে বড় গরুটি কেনার পেছনে এই মনস্তত্ত্ব কাজ করে। তবে এই কৌশলটি কেবলমাত্র সীমিত পরিসরে প্রয়োগ করা যাবে। অ্যান্টিক জাতীয় আইটেমের ক্ষেত্রে এই কৌশলটি গ্রহণ করা হয়। অর্থনৈতিক মন্দার সময় সবচেয়ে ভালো কৌশলটি হবে “মিতব্যয়িতার” কৌশল। ‘অত ভালোও দরকার নাই, আর অত দামেরও দরকার নাই’। অর্থাৎ পণ্যটিকে সাদামাটা করে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো রেখে কম দামে পণ্যটি বাজারে ছাড়া। মন্দার সময় মানুষ পণ্যের বাহুল্যের চেয়ে আবশ্যকীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এই “মিতব্যয়িতার” কৌশল অবলম্বন করে করোনা কালীন সময়ে বা করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করতে পারে।

ড. মীজানুর রহমান , উপাচার্য
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক পত্রে পুতিন বলেন ‘রাশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বের...

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, আল খারজ বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ও আল কাসিম বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন...

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের ও সুইস পর্যবেক্ষক দল।দুপুর একটার দিকে উপজেলার কয়েকটি ভোট...

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার উদ্দেশ্যই ট্রেনে আগুন দেয়া হয় বলে জানায় ডিবি। বিএনপি...