বিভাগ ইতিহাস

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অমরত্ব মলিন হওয়ার নয়

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

আপনি যদি আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশে যান এবং নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দেন, প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে আপনার সামনের মানুষটির কিছুটা অদ্ভুত উচ্চারণে, সুর করে ‘বাংলাদেশ’ বলে ওঠার।

এর কারণ জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি এবং আজ ১ আগস্টই হলো সেই দিন, যেদিন অমরত্ব লাভ করেছিল এই গানটি, এবং ৪৯ বছর পরও, বিশ্বাঙ্গনে দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটির পরিচয়ের অনেকটাই নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ছিল রবিবার। এ দিনই নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। তবে আদতে কনসার্ট একটি হওয়ার কথা থাকলেও, মানুষের চাপে শেষ পর্যন্ত আয়োজকরা বাধ্য হয় দুইটি কনসার্ট আয়োজনের। একটি দুপুর আড়াইটায়, আরেকটি রাত আটটায়।

এই কনসার্টের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যখন বিপর্যন্ত, দলবেঁধে সবাই শরণার্থী হিসেবে পাড়ি জমাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে, এবং তারও আগে থেকে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অধিকাংশ বাঙালিই যখন অসহায়, তখন তাদের সাহায্যার্থে কিছু করার জন্য তিনি প্রথম যোগাযোগ করেন জনপ্রিয় বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে।

হ্যারিসন এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগী হয়ে অন্য শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মাত্র পাঁচ সপ্তাহের প্রস্তুতিতে কনসার্টটির আয়োজন করা হয়। হ্যারিসন প্রথমে তার প্রাক্তন দল দ্য বিটলসের সদস্যদের অনুরোধ করেন এই কনসার্টে যোগ দিতে।.কিন্তু সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেন পল ম্যাকার্টনি, কেননা দলের সঙ্গে ওই মুহূর্তে কোনো সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন নারাজ।.জন লেনন অবশ্য রাজিই ছিলেন, কিন্তু একই সময়ে আদালতে তার সন্তানের ব্যপারে তার স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন বলে শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি।

এদিকে মিক জ্যাগার তখন দক্ষিণ ফ্রান্সে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তার পক্ষেও আসা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত কনসার্টে যোগ দেন বিটলসের প্রাক্তন তারকা রিঙ্গো স্টার, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিওন রাসেল, হ্যারিসনের নতুন দল ব্যাড ফিঙ্গারের যন্ত্রীদল ও আরো অনেকে। বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর এটিই ছিল হ্যারিসনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা প্রথম কোনো অনুষ্ঠান।

প্রায় পাঁচ মাস পর এই কনসার্টের মাধ্যমে সরাসরি কোনো অনুষ্ঠানে গান করেন এরিক ক্ল্যাপটনও। আর ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো দর্শকদের-শ্রোতাদের সামনে আসেন বব ডিলান।

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর সূচনা হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে। এ কনসার্টের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ধুন’ বলে নতুন একটি সুর। তার সঙ্গে সরোদে যুগলবন্দী ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান। এছাড়া তবলায় সহযোগিতা করেছিলেন বিখ্যাত আল্লারাখা, এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।

কনসার্টের প্রধান আকর্ষণ, প্রতিবাদী গানের রাজা ডিলান গেয়েছিলেন মোট ছয়টি গান।.এর মধ্যে ‘মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ যেমন ছিল, তেমনই ছিল তার নিজের লেখা ও সুর করা ৫০ লাইনের বিখ্যাত গান ‘আ হার্ড রেইন ইজ গোননা ফল’।

অপরদিকে কনসার্টের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা জর্জ হ্যারিসন নিজেও গেয়েছিলেন ছয়টি গান। তার গাওয়া সর্বশেষ গানটি ছিল এই কনসার্টকে সামনে রেখে লেখা বিখ্যাত সেই গান, ‘বাংলাদেশ’।

গানটির শুরুটা ছিল এরকম:

My friend came to me
With sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies

Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I’m asking all of you
To help us save some lives…

এই কনসার্টে মোট লোকসমাগম হয়েছিল ৪০ হাজার।কনসার্টের প্রাথমিক গেট রিসিপ্ট থেকেই উঠে যায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ দশমিক ৫০ ডলার, যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যবহৃত হয়। ৪০টি মাইক্রোফোনে অনুষ্ঠানের গান ও কথা রেকর্ড করে তিনটি লং প্লেয়িং নিয়ে একটি বড় অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়, সঙ্গে ছিল বহু রঙে মুদ্রিত সেই অনুষ্ঠানের একটি সুদৃশ্য সচিত্র পুস্তিকা। এছাড়াও প্রকাশিত হয় একটি বেস্টসেলিং লাইভ অ্যালবাম, আর অ্যাপল ফিল্মসের ব্যানারে কনসার্টের তথ্যচিত্র সিনেমাহলে মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের বসন্তে।

১৯৮৫ সাল নাগাদ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ লাইভ অ্যালবাম, তথ্যচিত্র এবং আনুষঙ্গিক থেকে আনুমানিক ১২ মিলিয়ন ডলার ওঠে, যা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরেও অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রের ডিভিডি থেকে আয়ের পরিমাণ বাড়া অব্যাহত থাকে, যে অর্থ ঢোকে ইউনিসেফের জর্জ হ্যারিসন তহবিলে।

সব মিলিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে আয়োজন ছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। অনেকেই বলে থাকে, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না।.কিন্তু এই কনসার্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি যা-ই হোক, দেশটির সাধারণ মানুষ ঠিকই ছিল শোষিত-নির্যাতিত বাঙালির পক্ষে।

তাই তারা শুধু কনসার্টের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থ সাহায্যই করেনি, বরং এই কনসার্টের মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থা।.এর কয়েক দশক পর, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “মাত্র একদিনেই গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল বাংলাদেশের নাম। সত্যিই এটা ছিল অসাধারণ একটি অনুষ্ঠান।”

সত্যিই এই কনসার্টের অসাধারণত্ব কোনোদিন মলিন হওয়ার নয়। সঙ্গীত, রাজনীতি ও মানবতাকে যে একই সুতোয় গাঁথা যায়, তার সার্থক প্রমাণ মিলেছিল এই কনসার্টের মাধ্যমে। তাই বিশ্ব ইতিহাসে এই কনসার্ট চিরকাল হয়ে থাকবে অবিস্মরণীয়।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024

ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করে ট্রেনে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের আগে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশি সংস্থা, মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের মনোযোগ নেয়ার…

January 6, 2024

এমনটা কেনো করলেন এ. আর রহমান?

হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিবাদের…

November 12, 2023

ন্যানোমিটার সেমিকন্ডাক্টর বা চীপ তৈরিতে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে চীন

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নিয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।…

September 25, 2023
Sponsored