দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ (New Moore Island) আমাদের সাতক্ষীরা আর ভারতের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা বরাবর হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় উত্তাল বঙ্গপোসাগরে জেগে ওঠা আধা ক্রোশ আকারের ছোট্ট এক বালুর জাজিরা। ইন্দো-ব্ঙ্গ সম্পর্কের সুদীর্ঘ টানাপোড়েনের অন্যতম উৎস। শেষপর্যন্ত কে পেলো এর মালিকানা?
১৯৭০এর ‘ভোলা’ সাইক্লোনে পূর্ব পাকিস্তানের ৫ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলো। ঝড় ও বন্যায় বাস্তুহারা হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সহায়তার ক্ষেত্রে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নিদারুণ উদাসীনতা ও নিরুত্তাপ উপেক্ষা ৭১এর স্বাধীনতার দাবীকে তীব্রতর করার পেছনে অন্যতম হেতু।
লক্ষ মানুষের জীবন ও ঘর, সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া সেই কখনো ভুলতে না পারা ঝড়ের আরেক সৃষ্টি এই জনমনুষ্যহীন দ্বীপ, যার নাম রাখা হয় “দক্ষিণ তালপট্টি”। যা থেকে সূচনা হয় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার চার দশক ব্যাপী এক ভূরাজনৈতিক কোন্দল। কি ঘটেছিলো শেষমেশ দক্ষিণ তালপট্টির? কে জিতেছিলো রুদ্র প্রকৃতির সৃষ্ট এই সুদীর্ঘ সীমান্ত বৈরিতা?
১৯৭১এর মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিম বঙ্গ সরকার প্রথম এই দ্বীপটির অবস্থান আবিষ্কার করে ও এর নাম দ্যায় The New Moore Island বা পূর্বাশা দ্বীপ। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার ভূসম্পদ প্রকৌশল উপগ্রহ (ERTS-1) প্রথমবারের মতো দ্বীপটিকে চিহ্নিত করে। যদিও অর্ধচন্দ্র আকৃতির এই দ্বীপটিতে কখনোই কোন জনগোষ্ঠীর স্থায়ী আবাস গড়ে ওঠেনি, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের কাছেই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অধিকারের প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিলো। কোনপক্ষই দ্বীপটির ভাগাভাগি বা যৌথমালিকানার কথা ভাবেনি। অনেকটা কবিতার মতো- “কোন বিবেচনা নয়, এখানে দখল নিতে হয়। সবটুকু জমি যার; তৃষ্ণার জল…!”
একরত্তি জমির জন্য অবশ্যই এতো দ্বন্দ্ব না, সচরাচর যেটা হয়ে থাকে, ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা এই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে জমা হয়ে আছে তৈল-গ্যাসীয় সম্পদের এক সুবিশাল ভান্ডার, সেই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (EEZ) দিকেই ভারত/বাঙলা দুদেশের দৃষ্টি।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুযায়ী একটা দ্বীপের উত্থানের সময় প্রাথমিক অবস্থান যে দেশের মধ্যে পড়ে, সেই দেশই এর মালিক হয়। সে হিসেবে ভারত এর উপর নিজের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবী করে। কিন্তু দক্ষিন তালপট্টি মূলতঃ একটা বালিয়াড়ি ছাড়া আর কিছুই না। ক্রমাগত ভেসে আসা পলির বদৌলতে কালে এর আকার বৃদ্ধি পেয়ে ১০ বর্গ কিঃমিঃতে পরিনত হয়৷ সেই সাথে ভারত/বাঙলাদেশের সীমান্ত নির্ণয়কারী র্যাডক্লিফ রেখার নির্ধারক হাড়িয়াভাঙ্গা নদীতে ভাঙন ও দিক পরিবর্তনের ফলে মোহনা ঘুরে গিয়ে দ্বীপটিকে কখনো ভারত, কখনো বাঙলাদেশের সীমানার মধ্যে দ্যাখায়। এছাড়া পরবর্তী অনুসন্ধানে জানা যায় যে দ্বীপটির পানির নীচে ডুবে থাকা একাংশ বাঙলাদেশের মূলভূমির তালপট্টি অঞ্চলকে ছুঁয়েছে।
সে হিসাব ধরে ৭০ দশকের শেষাংশে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ভারত সফরকালে হালনাগাদ মানচিত্র ও যথাযত নথি পেশ করেন, যাতে পরিষ্কার ভাবে দ্যাখা যায় যে দক্ষিণ তালপট্টি বর্তমানে বাঙলাদেশের অংশে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮১ সালে ভারত দ্বীপটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর (BSF) একটি অস্থায়ী চৌকি স্থাপন করে। তারউপর দ্বীপটিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর নিয়মিত টহল শুরু হয়। অর্থাৎ গায়ের জোরেই দ্বীপটির দখল ন্যায় ভারত। ফলশ্রুতিতে সেনাশাসক জিয়া বা তৎপরবর্তী সরকারগুলো দ্বীপটির ওপর বাঙলাদেশের দাবী প্রতিষ্ঠায় কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণ রুপে অপারগ হয়।
উপরন্তু ১৯৯০এর বৃটিশ এডমিরালটি চার্টের জরিপ ও ৯১এর আমেরিকার জাতীয় ভূতত্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দ্বীপটির মালিকানা পড়ছে ভারতের অংশে। অর্থাৎ সম্পূর্ণরুপে বাঙলাদেশের হাতছাড়া হবার জোগাড় হয় দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ।
২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙলাদেশ আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসীন হয়, এবং একই বছরের অক্টোবরে বাঙলাদেশ সরকার দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অধিকার দাবী করে নেদারল্যান্ডসের হগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সীমান্ত বিরোধ মিমাংসা আদালতের (PCA) শরণাপন্ন হয়। দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পর ২০১৪এর জুলাইয়ে আদালত বাংলাদেশের পক্ষে রায় দ্যায়।
এর ফলে মূল দ্বীপটি ভারত পেলেও বিতর্কিত ২৫,০০০ বর্গ কিঃমিঃ সমুদ্রসীমার মধ্যে ১৯,৪৬৭ বর্গকিঃমিঃ, অর্থাৎ ৫ ভাগের ৪ ভাগ, জমি ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মালিকানা পায় বাঙলাদেশ, যা তৈলগ্যাসীয় সম্পদে ভরা।
দ্বীপটির অবস্থান বরাবর জমি ভারতকে দেওয়া হলেও এর বহু পূর্বে ২০১০ সালেই পশ্চিম বঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ আবিষ্কার করে যে বৈশ্বিক উষ্ণাযনের প্রকোপে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিতর্কিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি সমুদ্রের জলের নীচে তলিয়ে গ্যাছে। অর্থাৎ বাঙলাদেশ পেল চার পঞ্চমাংশ নৌসীমানা যা কিনা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আর ভারত পেল এক পঞ্চমাংশ নৌসীমানা আর একটি ডুবে যাওয়া দ্বীপের স্মৃতি!
বর্তমানে দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের নীচে হারিয়ে গ্যাছে। কিন্তু ধারণা করা হয় যে পানির নীচে হলেও নদীবাহিত পলির কল্যাণে এর আয়তন বেড়ে একসময় ২৫ বর্গকিঃমিঃতে পরিণত হতে পারে। প্রকৃতির খেয়ালে আবার যদি কখনো ভেসে ওঠে দক্ষিণ তালপট্টি, তাহলে কি আবার শুরু হবে আরেক অর্ধশতাব্দী দীর্ঘ সীমান্ত কোন্দল?
আশার কথা হচ্ছে -না! আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে Permanent Court of Arbitration-PCA’তে একবার রায় হয়ে গ্যালে সে রায়ের উপরে আর পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যায় না, সীমানা যেভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে সেটাই হবে চিরস্থায়ী।
https://pubag.nal.usda.gov/catalog/5233755
http://en.banglapedia.org/index.php?title=South_Talpatti_Island
https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_disputed_territories_of_India
https://www.theguardian.com/world/cif-green/2010/mar/24/india-bangladesh-sea-levels
https://www.nydailynews.com/news/world/global-warming-resolves-30-year-land-dispute-india-bangladesh-coveted-island-sinks-article-1.164043
https://en.m.wikipedia.org/wiki/New_Moor
https://www.ndtv.com/india-news/un-tribunal-resolves-40-year-old-maritime-dispute-between-india-and-bangladesh-587571
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bangladesh%E2%80%93India_border
https://www.cntraveler.com/stories/2015-05-11/the-island-that-disappeared-because-of-climate-change
http://mandalaprojects.com/ice/ice-cases/talpatti.htm