বিভাগ ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয়ের কারণ এবং লৌহমানবের ভবিষ্যৎ

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর ১৯৪০ সালের দিকে সভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যাণ্ড যুদ্ধে বড় ধরণের পরাজয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মানীর হিটলার বাহিনী স্টালিনের সভিয়েত ইউনিয়নে গোপনে সামরিক আগ্রাসনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে ফিনল্যাণ্ডের মাত্র ৬৫ হাজার সামরিক বাহিনীর কাছে সভিয়েত স্টালিন বাহিনীর প্রায় ২,২৫,০০০ সেনার মৃত্যুবরণ এবং চুড়ান্ত পরাজয়কে হিটলার সুবিশাল সভিয়েত ইউনিয়নকে দখল করা খুবিই সহজ হবে বলে মনে করে। এর ফলস্বরুপ হিটলার সভিয়েত ইউনিয়নের সাথে করা অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে তার সেনা বাহিনীকে সরাসরি সভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমনের আদেশ দেন। অবশ্য তৎকালীন সময়ে নাৎসি বাহিনীর কিছু বিচক্ষণ জেনারেল সভিয়েত আক্রমনের বিরোধীতা করলেও হিটলার এতে কর্ণপাত করেন নি। করং হিটলার তার সেনা বাহিনীকে খুব দ্রুত সভিয়েত ইউনিয়ন দখলের আদেশ দেন। হিটলারের নাৎসী বাহিনী মাত্র ৫ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে গোটা সভিয়েত ইউনিয়ন দখলে আনার পরিকল্পনা করে ভয়াবহ আক্রমন শুরু করলেও বিষয়টি আসলে নাৎসী বাহিনীর জন্য ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী, খুবই জটিল এবং ভয়াবহ আকারের বিপদজনক এক সিদ্ধান্ত।

আসলে ১৯৪১ সালর ২২ জুন হিটলার অপারেশন বারবারোসা নামে পরিচিত সোভিয়েত দখলের অভিযান শুরু করে হিটলার বাহিনী। এই অভিযানে উনিশটি ডিভিশনে ৮ লক্ষাধিক সেনা, ৩ হাজার ট্যাংক, ২৫০০ বিমান এবং ৭০০০ কামান নিয়ে যুদ্ধ আরাম্ভ করলেও প্রায় ৩৫০০ কিলোমিটারের সুবিশাল সভিয়েত সীমান্তে একাধিক ফ্রন্টে এক সাথে যুদ্ধ পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করাটা হিটলারের নাৎসী বাহিনীর জন্য ছিল খুবই কঠিন এবং জটিল একটি কাজ। তাছাড়া জার্মানীর নাৎসী বাহিনী তৎকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি হলেও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বাহিনীর পাশাপাশি একই সাথে স্টালিনের সভিয়েত বাহিনীর মোকাবেলায় যথেষ্ঠ মানের শক্তিশালী ছিল না তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

আবার সে সময়ে বিশ্বের আরেক উদীয়মান সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি জার্মানীর হিটলার বাহিনী। যাই হোক, সভিয়েত আক্রমনে নাৎসী বাহিনীর মুল পরিকল্পনা ছিল যত দ্রুত সম্ভব তাদের দেশে ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্র এবং বড় বড় শহরগুলো দখল করে জার্মান বাহিনীর তেলের চাহিদা ও সংকট মোকাবেলা করা। সভিয়েত আক্রমনের প্রথম দিকে নাৎসি বাহিনী ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেও কিছু দিনের মধ্যেই তারা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পরতে থাকে। আসলে লাগতার যুদ্ধ, সভিয়েত ইউনিয়নে তীব্র ঠাণ্ড এবং প্রতিকূল পরিবেশে ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকে। বিশেষ করে তীব্র ঠাণ্ডায় এবং প্রতিকুল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে রোগে ও খাদ্যাভাবে হাজার হাজার সেনা মৃত্যুবরণ করতে থাকে।

প্রাণঘাতী এই সামরিক আগ্রাসনে ইতিহাসে অল্প সময়ের মধ্যে দুই পক্ষেই প্রায় ১ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আসলে এ যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনী জার্মানীর আক্রমনের মুখে পিছু হঠতে থাকলেও তাদের পোড়া মাটি নীতির যুদ্ধ কৌশলের কাছে বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকে জার্মানীর হিটলার বাহিনী। স্টালীনের পোড়া মাটি নীতি বলতে বুঝায়, সভিয়েত বাহিনী পিছনে সরে গেলেও, যাওয়ার সময় তাদের নিজের শহর এবং বন্দরের সকল সুবিধা যেমন তেলক্ষেত্র ও পানি ও খাদ্যের উৎস ধ্বংস করে দিয়ে পিছনে হঠতে থাকে। এতে করে জার্মান বাহিনী কোন সভিয়েত শহর বা বন্দর দখল করলেও বাস্তবে সেখানে বিশেষ কোন সুযোগ সুবিধা পেত না। বিশেষ করে সভিয়েত ইউনিয়নের তেলক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় হিটলারের তেলক্ষেত্র দখলের মূল পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানী সরবরাহের নতুন উৎস নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল এক রকম ভেস্তে চলে যায়।

তাছাড়া যুদ্ধের শেষের দিকে সভিয়েত ইউনিয়নে অতি মাত্রায় শীত এবং ব্যাপক তুষারপাত শুরু হলে -২৫ ডিগ্রী শীতল তাপমাত্রায় জার্মান সেনাদের বেঁচে থাকাটা এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। চরম মাত্রায় খাদ্য ও পানীয় ঘাটতি, জ্বালানী সংকট এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত গোলা বারুদ এবং যুদ্ধাস্ত্র সংকটে সভিয়েতের মাটিতে জার্মানীর হিটলারের বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়। আর এই সভিয়েত আগ্রাসন যুদ্ধে নাৎসী বাহিনীর প্রায় ৬,৮০,০০ বা ৮০% সেনা মৃত্যুবরণ করলে সার্বিকভাবে এর বিরুপ প্রভাব কিন্তু গোটা ইউরোপ জুড়ে চলমান প্রায় সকল স্পর্শকাতর ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর উপর পড়ে এবং ফলস্রুতিতে প্রায় সকল ফ্রন্টেই জার্মান বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে যায়। আর এভাবেই পরি সমাপ্তি ঘটে বিংশ শতাব্দির এক ভয়ানক এবং প্রাণঘাতী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর মূল হোতা লৌহমানব বা ডিটেক্টর হিটলারের। তাছাড়া ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১তারিখে মাত্র ৫ মাস, ১ সপ্তাহ ও ৬ দিনের মাথায় এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এর মাধম্যে হিটলারের করুণ পরিণতি ও পরাজয় কিন্তু এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়।

এখানে খেয়াল করে দেখুন, বিশ্বের প্রায় সকল লৌহমানব বা ডিক্টেটর নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিজের ভূল সীদ্ধান্ত এবং অহমিকতায় নিজের পতন নিজেই ডেকে আনে। জার্মানীর হিটলার নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত তার গুরুতর ভূলের কারণে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। আবার প্রায় ২৫০ খ্রীষ্টাব্দ পূর্বাব্দে যদি আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেটের বিশ্ব জয়ের কথা বলা হয়, তাহলে সেখানেও কিন্তু মহা ক্ষমতাশীল হয়েও মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেট শেষ অবধি ভারত বর্ষ দখলে এসে নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বিশ্ব জয়ের নেশা এবং অতি মাত্রায় যুদ্ধ আসক্তিই মুলত খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মহান ডিক্টেটর বা লৌহমানব আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেটের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে মন একরা হয়। ঠিক একই পথ ধরে বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর লৌহমানব নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং বিংশ শতাব্দীর হিটলার, মুসোলিনী, সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফী এবং রবার্ট মুগাবের মতো লৌহমানব বা ডিটেক্টর নিজের দেশে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু কেউই নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।

বরং তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে এসব কথিত ডিক্টেটরদের কর্মফল বা অপকর্মের জন্য কিন্তু নিজ দেশের অধিবাসীদেরও দীর্ঘ মেয়াদে চরম মূল্য দিতে হয়েছে বা এখনো অনেক দেশকে হচ্ছে। বর্তমানে সাদ্দামের ইরাক ও গাদ্দাফীর লিবিয়ার এহেন চরম মাত্রায় এবং দীর্ঘ মেয়াদী ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি বলে দেয় দেশগুলোর আজ কি করুণ অবস্থা। এদিকে সিরিয়ার বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে সিরিয়াকে আজ এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছে। প্রায় নয় বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় প্রায় আট লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের করুণ মৃত্যুর পাশাপাশি দেশটির আজ প্রায় ছয় থেকে সাত মিলিয়ন মানুষ নিজ দেশেই কিংবা অন্য কোন দেশের শরণার্থী শিবিরে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে বলা চলে শুধুমাত্র একজন ডিক্টেটর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব থেকে আজ একটি সমৃদ্ধ সিরিয়ান জাতি বিলুপ্তির পথে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া নাটোর, বাংলাদেশ।

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored