বিভাগ ইতিহাস

৭১ এর মত পাকিস্তান কর্তৃক নির্যাতিত পাকিস্থানের বর্তমান বিষফোঁড়া বেলুচিস্তান

সাম্প্রতিক সংবাদ
মুনতাহা মিহীর
Sponsored

বহু দশক ধরেই পাকিস্তানের শরীরে একটি বিষফোঁড়ার মতো টিকে আছে বেলুচিস্তান। কিন্তু বেলুচিস্তান শুধু পাকিস্তানের অংশ না। বেলুচিস্তানের সীমান্তের সঙ্গে আরও দুটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তান ছাড়াও আফগানিস্তান ও ইরানের কিছু অংশের ভেতরে বেলুচিস্তান প্রবেশ করেছে। বেলুচিস্তানের প্রায় ৭০% অংশ রয়েছে পাকিস্তানে এবং বাকী ৩০% ইরান ও আফগানিস্তানের মাঝে। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় স্টেটগুলোর মধ্যে একটি।

যদিও পাকিস্তানের যেকটা স্টেট রয়েছে তার মোটামুটি সবগুলোই আকার আকৃতির দিক থেকে বেশ বড়। আমরা জানি পাঞ্জাবের দুটি অংশ। একটি ভারতে অপরটি পাকিস্তানে। পাকিস্তান অকুপায়েড পাঞ্জাব  ভারতের অকুপায়েড পাঞ্জাবের চাইতে বড়। পাকিস্তানের রাজ্যগুলো ছাড়াও একটি ট্রাইবাল এরিয়া বা FATA রয়েছে। এর অর্থ, Federally Administrate Tribal Aria। এছাড়াও পাকিস্তানের গিলগিট ও বেলুচিস্তান নামের আরও একটি প্রদেশ রয়েছে। যদিও কেউ কেউ এই স্টেটটিকে কাশ্মীরের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন কিন্তু স্টেটটি সম্পূর্ন আলাদা।

স্বাভাবিকভাবেই বেলুচিস্তানে বেলুচ জনগণের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও কিছু পাস্তুনের বাস রয়েছে সেখানে। বেশিরভাগ পাস্তুন বা পাক্তুনের বাস করে আফগানিস্তান বা FATA এলাকায় এবং সামান্য কিছু পাস্তুনের বাস এই অঞ্চলেও রয়েছে। এছাড়া ব্রাহুই উপজাতি, হাজারা উপজাতি সহ, কিছু পাঞ্জাবী ও সিন্ধি লোকজন এই অঞ্চলে বাস করে। বেলুচিস্তানে বেশিরভাগই ট্রাইবাল লোকজন বাস করে। আরবান পপুলেশনের সংখ্যা একেবারেই কম। বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীর নাম কোয়েটা। কোয়েটায় বেশ কয়েকটি পর্বত রয়েছে তবে মূল শহরটির অবস্থান সুলাইমান পর্বতশ্রেণীতে। কোয়েটায় যাওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত রাস্তা হল বোলান পাস। বোলান পাস ঐতিহাসিকভাবে সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষকরে তাদের জন্য যারা আফগানিস্তান হয়ে ভারববর্ষ আক্রমণে আসতো, এবং ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত থেকে আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য বোলান পাসই ব্যবহার করতো।

এই অঞ্চলে দুটো গিঁড়িপথ ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি খাইবার পাস, অপরটি বোলান পাস। এই দুটি পাসই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযুক্ত করেছে। খাইবার পাস পেশোয়ার থেকে কিছুটা উপরে, অর্থাৎ উত্তরে। এবং বোলান পাস পাকিস্তানেই অবস্থিত, কোয়াটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কোয়াটার থেকে সামান্য এগিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার। বেলুচিস্তান মূলত শুষ্ক, মরুভূমি, পাহাড়ি এলাকা। এই এলাকায় কয়েকটি পর্বতমালা রয়েছে। যেমন ব্রাহুই পর্বতমালা, সুলেমান পর্বমালা ইত্যাদি। চারপাশে পাহাড়, মাঝে কিছু মরুভূমি এলাকা মিলিয়ে পুরো এলাকা মোটামুটি শুষ্ক। এই অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয় না। স্থানীয় উপজাতিরা চলাচলের জন্য উট, গাধা ব্যবহারের মাধ্যমে এখনও বেশ প্রাচীন পদ্ধতিতে জীবন ধারণ করে। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভীষণ অভাব রয়েছে।

প্রাচীনকালের বেশ কিছু ঐতিহাসিক নথিপত্রে বেলুচিস্তানকে গেড্রোশিয়া বা জেড্রোশিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রমাণিত ইতিহাস মক্কার চাইতেও প্রাচীন। Gedrosia একটি গ্রীক শব্দ। আলেক্সান্ডার যখন ভারববর্ষ অভিযানে আসেন তখন এখানে বেশ কিছু ইউরোপিয়রা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এরপর যতবার এই অঞ্চলে অভিযান সম্পাদিত হয়েছে প্রতিবারই এই এলাকাকে আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। গেড্রোস নামটি গ্রিক ইতিহাসবিদদের দেওয়া।  গেড্রোস মূলত বেলুচিস্তানের একটি এলাকার নাম। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে বেলুচিস্তানকে মেহেরগড়ও বলা হত।

সিন্ধু উপত্যকার এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন অংশ। সিন্ধু সভ্যতার প্রোটো স্টেজে অর্থাৎ শুরুর দিকে এই অঞ্চল বেশ উন্নত ছিল। হড়প্পা ও মোহনজোদারো সভ্যতার চাইতেও এটিকে পুরাতন ভাবা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ইতিহাস এগুতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত বেলুচিস্তান ইংরেজদের কব্জায় চলে আসে। সে সময় বেলুচিস্তানে চারটি মূল অঞ্চল ছিল। যাকে আলাদা রাজ্যও বলা যায়। এগুলো হল মাকরান, খারান, লাস বেলা ও কালাত-ই-খানেত। তৎকালীন সময়ে এই চারটি অঞ্চল মিলেই বেলুচিস্তান ছিল।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামের যখন আলাদা দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন মার্চ ১৯৪৮ সালে এই রাজ্যগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যুক্ত হয়ে যায় ঠিক সেভাবে যেভাবে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চুক্তির সময়েই এদের অন্তঃদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। কিছু শর্ত স্থানীয় মানুষ একমত হত না পারার কারণে চুক্তি সর্বসম্মতভাবে সাক্ষরিত হয়নি ফলে তখনই এন্টি পাকিস্তান দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে গিয়ে বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হয়। বেলুচিস্তানের দাবীগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবী ছিল নুন্যতম স্বায়ত্বশাসন। শুরুর দিকে পুরোপুরি স্বাধীনতা তারা চায়নি। স্বায়ত্তশাসনের দাবীগুলো ছিল এমন: রাজ্যের প্রশাসনিক দায়িত্ব স্থানীয়রা পালন করবে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যোগাযোগ, বৈদেশিক সম্পর্কের মত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন প্রবল বাঁধার মুখে চুক্তি সম্পাদিত হয় ও পাকিস্তান ঠিক পূর্ব পাকিস্তানের মতই বেলুচিস্তানের উপরে ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু করে। অপরদিকে পরবর্তীতে গিয়ে বেলুচিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী পুরোপুরি স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।

এখন প্রশ্ন হল, পাকিস্তানের সঙ্গে বেলুচিস্তানের এই দ্বন্দ্ব এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কিভাবে চলে আসছে? কেন বেলুচিস্তান চাহিবামাত্র স্বাধীনতা পাচ্ছে না? এর মূল কারণ হল, বেলুচিস্তানে বিশাল সব ভুগর্ভস্থ গ্যাস ক্ষেত্র ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। এগুলো এতটাই বড় যে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে সিংহভাগই অবদান রেখেছে বেলুচিস্তান। বেলুচ থেকে যত ন্যাচরাল গ্যাস বের হয় তার কোন সুবিধা স্থানীয়রা পায় না। একারণে পুরো পাকিস্তানের তুলনায় সেখানে দারিদ্রতার হার সবচেয়ে বেশি। উন্নয়নের কিছুই সেখানে ঘটেনি। সড়ক, বিদ্যুৎ, পানি সবকিছুরই বড় অভাব।

বেলুচের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের আরেকটি বড় কারণ হল ২০০১ থেকে চলে আসা আফগানিস্তানের যুদ্ধ। সেটার একটা স্পিলওভার ইফেক্ট বেলুচিস্তানের উপরে এসে পড়েছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধে তালিবান যোদ্ধাদের অনেকেই এসে বেলুচিস্তানে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন তারা স্থানীয়দের মাঝে এন্টি পাকিস্তান মুভমেন্ট আরও বাড়িয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য উস্কানি দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ আরও জোড়ালো হয়ে ওঠে। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ গত পঞ্চাশ বছর ধরে অবিরাম হয়নি। প্রথম বিদ্রোহ ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার পরে তাদের পাকিস্তানে যোগদানের সময়। পরবর্তী ১০ বছর সেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বহাল ছিলো। ১৯৫৮-৫৯ সালে আবারও বিদ্রোহ শুরু হলে পাকিস্তান আর্মি সেটা দমন করে। তখন যে বিদ্রোহ দল সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল তাদের সবাইকে হত্যা, গুম, নিরস্ত্র ও আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। একই ঘটনা ঘটে ৬২-৬৩ ও ৭৩-৭৪ সালে। ৭৩-৭৪ সালের বিদ্রোহে প্রচুর হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ কেননা তখন পূর্বপাকিস্তান সবে মাত্র ভেঙে গিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেছিল, আর পশ্চিম পাকিস্তান নতুন করে কোনো ভাঙন দেখতে চাচ্ছিল না। ফলে বিদ্রোহ দমন করতে পাকিস্তান সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। সেবার এত বেশি অত্যাচার নির্যাতনের শিকার বেলুচিস্তান হয়েছিল যে আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত তারা স্বাধীনতার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারেনি। ২০০৪ থেকে আবারও বেলুচ-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। স্থানীয়রা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তানের সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব এখনও চলছে। এখনও মাঝেমধ্যেই দুই পক্ষের গোলাগুলি, হতাহত ও চোরাগোপ্তা হামলা, বোমা হামলা, কিডন্যাপিং, রেইড, গুম, হত্যা চলছে।

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনে কিছু সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বেলুচ লিবারেশনস আর্মি, বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি, বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্ট সহ আরও বেশ কিছু দল আছে। এদের মধ্যে বেলুচ রিপাবলিকান পার্টির বর্তমান নেতা ব্রহ্মদাহ বুগতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার পিতামহ আকবর বুগতি ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই চলছে তাতে আকবর বুগতির অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বেলুচিস্থানের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি সেখানকার গভর্নর ছিলেন। পরে তার নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে বেলুচ রিপাবলিকান পার্টি। ২০০৬ সালে পাকিস্তান আর্মি আকবর বুগতিকে হত্যা করে, ফলে রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে পাক সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। ব্রহ্মদাহ বুগতি তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করলে পাকিস্তান আর্মির উপর্যুপরি রেইডে তিনি আফগানিস্তান পালিয়ে যান। এরপর ইউরোপে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। বেলুচিস্তানের দলগুলোর কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন তবে সবগুলো দলেরই নিজ নিজ মিলিশিয়া রয়েছে।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি আর্মি ও আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হল গুম। রাজনৈতিক বিরুদ্ধচারণ করা বহু নেতা, জনপ্রতিনিধিদের পাক আর্মি গুম করে ফেলে। তাদের কোনো এরেস্ট রেকর্ড থাকে না। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়ও না। তাদের জেলে ঢুকিয়েছে, নাকি টর্চার করেছে, নাকি সরাসরি হত্যা করেছে এর কোনো হদিশই পাওয়া যায় না। ইদানীং কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যায় পাকিস্তানি আর্মি তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্জন স্থানে গুলি করছে অথবা ক্রসফায়ারে ফেলছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য ও সঠিক তদন্তের দাবীতে দুই বছর পূর্বে প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটা থেকে রাজধানী ইসলামাবাদ পর্যন্ত হাজার কিলোমিটারের লং মার্চ করেছিল বেলুচিস্তানের জনগণ।

পাকিস্তান সরকার বেলুচ জনগনকে দমন করতে প্রচুর অমানবিক আচরণ করে। ফ্রন্টিয়ার কোর দ্বারা টর্চার, কিডন্যাপ, হুমকির মত ঘটনা সেখানে হরদম ঘটতেই থাকে।  বেলুচিস্তানের পাক-বাহিনীকে বলা হয় ফ্রন্টিয়ার কোর। বেলুচিস্তানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল উপজাতিদের মাঝে আন্তঃ কোন্দল। যেহেতু তাদের মাঝে অনেকগুলো ট্রাইব এক সঙ্গে বাস করে সেহেতু তাদের মধ্যে এলাকা নির্ধারণ, শিয়া-সুন্নি নিয়ে প্রায়শই যুদ্ধ বেঁধে যায়। উপজাতিগুলোর এই কোন্দলের জের ধরে পাকিস্তান সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাইবাল লিডারদের সঙ্গে একটি বেআইনি আপোষ রফার চেষ্টা করে। অর্থাৎ তাদের ঘুষ প্রদান করে। পাক সরকার টাকা দিয়ে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। অর্থ লোভী এই সর্দারেরা এমন একটা অবস্থা বজায় রাখে যাতে দেখা যায় তারা পুরোপুরি স্বাধীনতা সমর্থণ করে না আবার পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণও সমর্থণ করে না।

নিয়মিত অর্থ প্রাপ্তি ও জনগণের উপর প্রভাব থাকার কারণে তারা এই সিস্টেম থেকে সহসা বের হয়ে আসে না। মনে রাখতে হবে দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাইবাল লিডারদের সহায়তায়ই ১৯৪৮ সালে বেলুচিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্থানীয় গোত্রদের ইউনিটির অভাবের কারণেই বেলুচের স্বাধীনতার এত দীর্ঘসূত্রিতা, এত রক্তক্ষয়। এছাড়া মিডিয়াকে কঠোরভাবে দমনের ফলে সংবাদমাধ্যমে বেলুচরা কভারআপ কম হয়। একারণে আন্তর্জাতিকভাবে বেলুচিস্তানকে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান গুরুত্ব দেন না। এখন পর্যন্ত জাতি সংঘে বা অন্য কোথাও অফিশিয়ালি বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়নি ফলে এটি বরাবরই দৃষ্টি ও আলোচনার আড়ালেই থেকে গেছে।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের এত দমনপীড়নের কিছু ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। তাই পাকিস্তান কখনোই চাইবে না, বেলুচিস্তানের সঙ্গে যেন ভাঙন ঘটে৷ কারণগুলো লক্ষ্যনীয়।


১) পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ৪৪% অংশ হল বেলুচিস্তান। এত বিশাল ভূখণ্ড হওয়ার পরও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% বাস করে এখানে। বেলুচিস্তানে কয়লা, গ্যাস, মেটালের বেশ বড় বড় কয়েকটি খনি রয়েছে৷ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্রের নাম হল সুই গ্যাসক্ষেত্র যা বেলুচিস্তানে অবস্থিত।


২) বেলুচিস্তানের গোয়াদ্বারে একটি নৌ বন্দর রয়েছে। নৌবন্দরটি বানিয়েছে চীন। চল্লিশবছরের জন্য সেটি চীন নিজেদের ট্যাক্স ফ্রি জাহাজ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে। এছাড়া গোয়াদ্বার আরব সাগরের এমন একটি স্থানে অবস্থান করছে যার কারণে পাকিস্তান ভৌগলিকভাবে প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রের নৌ সীমায় নজরদারি ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করতে পারে সহজেই। তাই এটা পাকিস্তানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান, তারা কখনোই এটিকে হাতছাড়া করতে চাইবে না।


৩) পাক-চীনের ইকোনোমিক করিডোর এই অঞ্চলে রয়েছে। পাক-চীনের অর্থনৈতিক চুক্তি CPEC সাক্ষরিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন ঘটবে বেলুচিস্তান দিয়েই। সিপিইসির একটি ম্যাপটি লক্ষ্য করুন। এর মাধ্যমে চীন রাস্তা, রেল লাইন সহ বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মান করবে। CPEC একটি সড়ক বানাবে ইসলামাবাদ থেকে গোয়াদ্বার পর্যন্ত সরাসরি। ফলে পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি একটা আলোর মুখ দেখবে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে বেলুচিস্তানকে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে চীন ও পাকিস্তান উভয়ের স্বার্থে। তাই বেলুচ বিদ্রোহ দমনের জন্য চীনও পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা করে।

৪) সবশেষে ইরান পাকিস্তান গ্যাস পাইপ লাইন। ইরান থেকে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপ লাইন গেছে বেলুচিস্তানের উপর দিয়েই। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তবে এই পাইপ লাইন ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ পর্যন্তও আসবে। এটি একটি বিশাল প্রোজেক্ট। সম্ভবত আগামী বিশ্বে সবচেয়ে বড় প্রোজেক্টগুলোর একটি। আমাদের অর্থনীতির অনেকটা নির্ভর করে চীনের OBOR এবং ইরানের গ্যাস লাইন প্রোজেক্টের উপরে৷ তাই এগুলোর জন্য বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আফগান-বেলুচ অশান্ত পরিস্থিতির জন্য এই প্রোজেক্টগুলো থেমে আছে বহু দিন ধরে।

একটি জাতিগোত্রের বা অঞ্চলের মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অবশিষ্ট থাকে তা হল উক্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা। স্বাধীনতাই যদি না থাকে তবে খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র বাসস্থান, চিকিৎসারই বা কি দরকার? কিন্তু কোনটাই যদি না থাকে?

Sponsored
Leave a Comment

সর্বশেষ

পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে…

September 21, 2024

২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক

সাইমন সাদিক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে এবং বাইরে সফলতার সাথে…

March 4, 2024

ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে  সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো একটি নতুন কন্টিনজেন্ট ‘বাংলাদেশ আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ এর ১ম দল গণতান্ত্রিক কঙ্গো…

March 3, 2024

প্রধানমন্ত্রীকে পুতিনের অভিনন্দন

পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর…

January 12, 2024

আওয়ামী লীগের বিজয় উৎসব উদযাপন করলো রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন

রিয়াদ প্রতিনিধি- ১০জানুয়ারী বুধবার স্হানীয় সময় রাত সাড়ে ১০ঘটিকায় হোটেল ডি-প্যালেসে রিয়াদ মহানগর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,…

January 10, 2024

পর্যবেক্ষণে গিয়ে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও সুইস পর্যবেক্ষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের…

January 7, 2024
Sponsored