সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের নেতানিয়াহু সরকার প্যালেস্টাইনের পশ্চীম তীর এবং জর্ডান নদীর তীরবর্তী বেশ কিছু এলাকা দখলে নিয়ে নতুন আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মহা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। যা কিনা চলতি ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকেই শুরু করা হবে। তাছাড়া ইসরাইল ইতোমধ্যেই তাদের দখলকৃত গোলান মালভূমিতে নতুন বসতি সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে দিয়েছে বেশ জোরেশোরেই। যদিও ইসরাইলের এমন ভয়াবহ আগ্রাসী নীতির প্রবল বিরোধিতা করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষাকারী পঙ্গু সংস্থা ওআইসি এবং আরব লীগ। আর ইসরাইল সরকারের এহেন নতুন ভূমি দখলের আগ্রাসী পরিককল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে আবারো ভয়াবহ যুদ্ধের প্রবল আশাঙ্খা দেখা দিয়েছে।
যা হোক, পবিত্র ভূমি প্যালেস্টাইন এবং মুসলিম জাহানের প্রথম কেবলা আল-আকসা মসজিদকে রক্ষা করার জন্য ১৯৪৮ সালে ইসরাইল সৃষ্টির পর থেকে আরব দেশগুলো একত্রে ১৯৪৮, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্বল্প মেয়াদী এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু দূঃখজনকভাবে এই তিনটি যুদ্ধেই আরব দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ইসরাইলের কাছে শচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিধর দেশগুলো ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। তবে বর্তমানে অতি বিলাসিতায় মত্ত অলস আরব দেশগুলো শুধু তীব্র প্রতিবাদ ব্যাতিত হয়ত ইসরালের অগ্রাসন প্রতিহত করার মতো কোন শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হয় না। আর আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তৎকালীন সময়ে সভিয়েত ইউনিয়ন প্রতি বারই আরব দেশগুলোকে সমর্থন করার পাশাপাশি বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহ কিম্বা বিক্রি করে গেলেও কার্যত বাস্তবে ইসরালের দীর্ঘ মেয়াদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছে।
আসলে বর্তমানে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং গাজায় হামাসের সাথে প্রতি নিয়ত সামরিক সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। তবে খেয়াল করার মতো একটি বিষয় যে, এরুপ বিচ্ছিন্ন সামরিক সংঘর্ষ বা প্রতিটি যুদ্ধের পর পরই কিছু না কিছু এলাকা ইসরাইল নতুন করে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক নিজ দখলে নিয়ে নিচ্ছে। আর দীর্ঘ মেয়াদী মহা পরিকল্পনা ও চলমান কাজের অংশ হিসেবে নতুন ভূমি দখল বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে ইসরাইল। আর এভাবে চলতে থাকলে হয়ত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ইসরাইলের আয়তন লক্ষাধিক বর্গ কিলোমিটারে পৌছে যাবে। যা ২০৫০ দিকে পুরো প্যালেস্টাইন এলাকা বিলীন হয়ে এবং তার পাশাপাশি সিরিয়া, লেবানন এবং জর্দানের একটি বড় অংশ দখল করে ইসরাইলের আয়তন তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে পৌছে যাওয়ার প্রবল আশাঙ্খা থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে বেশ কয়েক বার সীমিত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মিলিশিয়া গ্রুপের ব্যাপক রকেট হামলা ও প্রতিরোধের মুখে পড়লেও ইসরাইলের ডিফেন্স ব্যাকবোন একেবারেই বিনষ্ঠ কিম্বা ধবংস হয়ে যাওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি আজো সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া হামাস ও অন্যান্য বিদ্রোহী সামরিক গ্রুপগুলো প্রায়ই সময়ে ইসরাইলের বেশ কিছু শহরে রাশিয়া কিম্বা ইরানের তৈরি নিম্ন মানের কাতিউশা মার্কা শতাধিক রকেট নিক্ষেপ করে গেলেও তাতে ব্যাপক আতঙ্ক ছাড়ানো ব্যাতিত ইসরাইলের পক্ষের প্রাণহানী কিংবা হতাহতের ঘটনা একেবারে নগন্যই বলা চলে। তাছাড়া এসব রকেট ইসরাইলের অবকাঠামো এবং সামরিক স্থাপনার বড় ধরণের কোন ক্ষতি করার সামর্থ আদৌ রাখে কি না তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। অথচ হামাসের এহেন অকার্যকর রকেট হামলার বিপরীতে ইসরাইল কিন্তু ঠিকই ভয়ঙ্কর পাল্টা বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে পবিত্র আরব ভূমির ব্যাপক ক্ষতিসাধন এবং হাজারো নিরীহ প্রাণহাণির বিষয়টি এক রকম নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর হামাসের এহেন তথাকথিত দূর্বল আকারের রকেট হামলা ও বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ আসলে ইসরাইলকে পাল্টা ব্যাপক হামলা ও নতুন ভূমি দখলের বিশেষ সুযোগ করে দিচ্ছে। যা কিনা আজ একটি অত্যন্ত দূঃখজনক এবং লজ্জার বিষয় হিসেবে মুসলিম উম্মাহর সামনে এসে দাড়িয়েছে।
তবে প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে অধিকাংশ আরব দেশগুলো কিছুটা গোপনে হলেও ইসরাইলের সাথে আপোষ রফা করে এবং গোপন সম্পর্ক স্থাপন করে মধ্যপ্রাচ্যে টিকে আছে। এমনকী মুখে মুখে তীব্র প্রতিবাদ করে গেলেও বিশ্বের কথিত নব্য সুলতানের দেশ তুরস্কের সাথে ইসরাইলের বানিজ্যিক সম্পর্ক ২৫.০০ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। আর ইরান প্রতিদিন একশো বার করে ইসরাইলে হামলা ও ধ্বংসের হুঙ্কার দিয়ে গেলেও ইরানের সামরিক বাহিনী এক রকম নিরবেই সিরিয়ায় মাটিতে ইসরাইলের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হজম করে যাচ্ছে। এটা প্রকাশ যোগ্য যে, ইরানের সরকার বার বার গোপন করার চেষ্টা করে গেলেও সিরিয়ার মাটিতে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ হাজার বা তার বেশি সংখ্যক ইরানী সেনা এবং হিজবুল্লাহ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক মিলিশিয়া সদস্য ইসরাইলের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র এবং পাশাপাশি সিরিয়ায় যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের হামলায় মৃত্যুবরণ করেছে। যার দায় কিন্তু ইরানের খোমেনী সরকার কোন ভাবেই এড়াতে পারে না।
বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কে যে কার বন্ধু কিংবা শত্রু তা বোঝা বেশ মুশকিল। যেমন লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকারকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক এবং দেশটি ইতোমধ্যেই লিবিয়ার তার সেনা, ড্রোন ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে। আবার অন্যদিকে জিএনএ সরকার বিরোধী হাফতার বাহিনীকে অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর ও অন্যান্য দেশগুলো। এদিকে সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাতে ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই সৌদি ও তার জোট সিরিয়ার বিদ্রোহী সামরিক মিলিশিয়াদের অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করে গেলেও বর্তমানে তুরস্ক-সৌদি বিরোধ চরম আকার ধারণ করায় এখন সৌদি আরব সিরিয়ার আসাদ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার ইয়েমেনে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৮% হুথী শিয়া জনগোষ্ঠী হলেও গৃহযুদ্ধের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইয়েমেনে ৭০% সুন্নী জনসংখ্যাকে নিধন ও উৎখাত করে হলেও দেশটির একটি বড় অংশ হুথী বিদ্রোহীদের দখলে নিতে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছে ইরান। আবার ইয়েমেনে সুন্নী সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে প্রতিনিয়ত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রেখেছে সৌদি ও তার জোট।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক মিডিল ইস্ট মনিটর নিউজের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সিরিয়ার ইদলিবে অবস্থতি ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর খ্যাত খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহঃ এবং তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আবদুল মালেকের সমাধি সৌধ (কবর) সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামের জন্য অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার এ মহান খলিফার কবরে আগুন জ্বালিয়ে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে আসাদ বাহিনী। পত্রিকাটির তথ্য অনুসারে, গত ২৮শে মে ২০২০ বৃহস্পতিবার সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আল-আসাদ বাহিনী হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহির কবরে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে এবং সমাধিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে সঙ্গে তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালেকের সমাধি সৌধও মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা আমীর শাসিত আরব দেশগুলো নিজ দেশের ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার কেউ আবার রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রয়োজন হোক কিংবা না হোক আরব দেশগুলো নির্বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া থেকে শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে। আর এভাবে বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের ৪০% পর্যন্ত চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। আবার অনৈক্যের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক রকম গোপনেই আরব দেশগুলোর কাছে চাঁদাবাজি যে করছে না তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। যদিও এসব অস্ত্র মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য কোন কাজে না আসলেও সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাকের সাধারণ নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, তুরস্ক এবং ইরানের মতো অঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতে উঠে মুসলিম বিশ্বকে কার্যত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখানে যে যার মতো করে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে ব্যস্ত এবং এহেন অপকর্মে উস্কানী এবং আগুনে ঘী ঢালার মতো ভয়ঙ্কর অপকর্ম করে যাচ্ছে বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলো।
ইসরাইলের অস্ত্র ভাণ্ডারে দুই থেকে তিন শতাধিক নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র থাকার বিষয়টি বিশ্বর সামনে প্রকাশ পাওয়ায় বিশ্বের প্রথম সারির সুপার পাওয়ার দেশগুলো তাকে অনেকটাই পরোক্ষভাবে হলেও সমীহ করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া ইসরাইলের রয়েছে নিজস্ব প্রায় ৪,৬০০ এর কাছাকাছি ডিফেন্স প্রযুক্তি নির্ভর সুবিশাল ইণ্ডাস্ট্রিয়াল হাব। তাছাড়া দেশটিকে ড্রোন প্রযুক্তির আঁতুড়ঘর বলা হয়। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের কোন এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের নিজস্বভাবে ডিজাইন এবং তৈরিকৃত রকেট মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে। অথচ মুসলিম বিশ্বের ষাট এর কাছাকাছি দেশ এবং সারা বিশ্বে ১.৭৮ বিলিয়ন সুবিশাল জনসংখ্যা থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এ দেশগুলো নিজস্ব প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মতো নিজেদের যোগ্য স্থান করে নিতে পারছে না। যা মুসলিম বিশ্বের জন্য খুবই হতাশাজনক একটি বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে হাজার হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এগুলো আসলে দেশ ও জাতিকে কার্যকরভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে ব্যার্থ হচ্ছে। আর বর্তমানে সারা বিশ্বে যে কোন মুসলিম দেশ কিংবা অন্য দেশে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠী সামরিক আগ্রাসন, নিধন, গণহত্যা ও বিতারণের শিকার হলে তাদের রক্ষায় এ মুহুর্তে বিশ্বে কেউ আছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারে রেহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতারণ তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
সিরাজুর রহমান, সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।