শিব নারায়ণ দাশ পিতা সতীশচন্দ্র দাশ। সেই ভদ্রলোক কুমিল্লা জেলায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা প্র্যাকটিস করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণে বাঁচলেন না সতীশচন্দ্র। সেইসময় তো এমনিতেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর অ”বর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল জা”মাতি রাজাকা”র, পাকি বর্বর”রা। সেই ধাক্কা থেকে রেহাই পাননি সতীশচন্দ্রও। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হ”ত্যা করে ওরা।
এই মানুষটি নিজেও ছাত্রলীগ করতেন। ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতির লাইনে পদার্পন তার। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন করে কারাবরণ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার।
পেছনে ফিরি একটু। ১৯৭০ সাল। জুন মাস। এই মাসের ৭ তারিখ পল্টন ময়দানে ছাত্রদের একটি সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেয়ার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সিদ্ধান্ত হয় এদিন বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে। সেই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় জয়বাংলা বাহিনী। এই বাহিনী একটা পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রষ্টব্য যে, এই পতাকাটিই পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে৷
যাই হোক, কুচকাওয়াজের আগের দিন ৬ জুন কতিপয় ছাত্রনেতা হাজির হন সার্জেন্ট জহরুল হক হলে, অবশ্য তখন হলটির নাম ছিল ইকবাল হল। সেই ইকবাল হলের ১১৬ নাম্বার রুমে (বর্তমান ১১৮ নং রুম) তখনকার ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ, হাসানুল হক ইনু, মনিরুল ইসলাম মনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা আলোচনা করতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে কেমন হবে পতাকার রুপ।
মনিরুল মনি মতামত দিলেন, পতাকার জমিন হবে ব্যাটল গ্রিন। শাহজাহান সিরাজ বললেন, রক্ত লাল একটা কিছু যেন থাকে পতাকায়। কাজী আরেফ বললেন, পতাকার মাঝখানে রক্ত লাল প্রভাত সূর্যের মাঝে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা থাকবে। পতাকার থিম মোটামুটি তারা ঠিক করে ফেললেন আলোচনা করে।
সেইসময় তো আজকের দিনের মতো এত শিল্পী, নকশাকার ছিলেন না। তাই স্মরণ করা হলো শিব নারায়ণকে। কুমিল্লা নিবাসী এই শিব নারায়ণকে ডাকা হলো সেদিন ১১৬ নাম্বার রুমে। সবাই জানে আঁকাআঁকিটা ভাল পারে শিব নারায়ণ।
শিব নারায়ণকে নির্দেশনা জানানো হলো। বুঝিয়ে বলা হলো থিম কি হবে। নিপুন শিল্পী খুবই দক্ষতার সাথে নকশা করে দিলেন পতাকার। এই পতাকাটিই একাত্তর সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে মুজিবনগরেও ওড়ানো হয় এই পতাকাটিই। উইকিপিডিয়াতেও শিব নারায়ণকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল ডিজাইনার হিসেবে। কিন্তু, বাস্তবিক অর্থে শিব নারায়ণ দাশ কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছেন আসলে? আমরা কতজনই জানি শিব নারায়ণের কথা? অথচ, বিস্মৃত এই মানুষটিই যে আমাদের প্রাণের জাতীয় পতাকার ইতিহাসে জড়িয়ে!
সেই পিতা হারানোর ক্ষত তো আছেই এর বাইরে যোগ হয়েছে স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমান। স্বাধীনতার পর পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে লাল সবুজের বর্তমান পতাকার রুপটি নির্ধারণ হয়। এই কাজের দায়িত্ব পান আরেক শিল্পী কামরুল হাসান। আর তাতেই আড়ালে পড়ে যান শিব নারায়ণ দাশ। পাঠ্যপুস্তক সহ সমস্থ জায়গায় জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃতি পান কামরুল হাসান। বিস্মৃত হয়ে যান শিব নারায়ণ দাশ। ফলে অভিমান জমা হয় তার মনে। সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।