উত্তাল ১৩ মার্চ১৯৭১ঃএই দিনে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ছিল উত্তাল সারা বাংলাদেশ। প্রতিদিনের মতো এদিনও ঢাকাসহ সর্বত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক- সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মিছিল-সমাবেশে ছিল মুখরিত।
লাখো মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রস্তুতিতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিরোধী দলের নেতারা পাকিস্তানের অনিবার্য ভাঙন নিশ্চিত বুঝতে পেরে একাত্তরের এদিন জরুরি বৈঠকে মিলিত হন।
বৈঠক শেষে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম দমনের নিষ্ঠুর পরিকল্পনা নিতে থাকে হানাদাররা।
কর্মচারীদের অনুপস্থিতির কারণে এদিনও বন্ধ থাকে সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেঁধে দেয়া সময়ানুযায়ী কাজ চলে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাসভবন, যানবাহনে ওড়ে কালো পতাকা।
এদিন সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌ- পরিবহন, ডক, পাট ও সুতা কলের শ্রমিক সংগঠনগুলো, ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল-সমাবেশ করে অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানায়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করে। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ লালবাগ আঞ্চলিক শাখার সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নিউজ পেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের বিশাল মিছিল নগরীর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সমবেত হয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণের দিকে ধাবমান- এ উপলব্ধি থেকে ৪৫ জাতিসংঘ কর্মীসহ ২৬৫ জন বিদেশি নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন।
এ নিয়ে বিকালে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ লালদীঘিতে জনসভা করে। জনসভায় নেতারা সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগ করতে আহ্বান জানান। চট্টগ্রামবাসীকে আসন্ন যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
সভায় পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে বিহারিদের অস্ত্র সরবরাহের কথা বলা হয়। এদিন শেরশাহ, ফিরোজ শাহ কলোনি, পতেঙ্গা, রেলওয়ে কলোনি, হালিশহর, পাহাড়তলীর বিহারি কলোনিগুলোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছিল পাক আর্মিরা।
টঙ্গীর অদুরে বোর্ড বাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা প্রান বিসর্জন দিয়েছে বাঙ্গালী জাতি তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেবে না। বাঙ্গালীরা এবার যেকোনো মূল্য এ তাদের বাচার দাবী আদায় করতে চায়। তিনি জনগণকে শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হাকিম মিয়ার সভাপতিত্তে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী, শহিদুল্লাহ হল জি এস খান মোঃ হাসান ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে এদিন,সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকুরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে।
সামরিক নির্দেশ জারির পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচন্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি ঠিক তখন নতুন করে এধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উস্কানি দেয়ার শামিল।
ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো সকালে করাচী থেকে বিমানে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে ন্যাপ প্রধান বলেন, বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একমত।
চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের সভানেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালোব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।
ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার বর্গসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের ত্যাগ কারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারের সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।
সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটিলিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে পূর্ববাংলায় যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানান। তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।