উত্তাল ২৪ মার্চ ১৯৭১ঃ সে দিন ছিলো বুধবার। মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক শেষ হয়েছে। ইয়াহিয়া- ভুট্টো বাঙালির দাবি মেনে নেবে না, সর্বত্র প্রশ্ন। এদিন বঙ্গবন্ধুও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই।” তখন জাতির পিতা কোনও প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।
সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০নং সেক্টরে একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়েছে। বোমা হামলা করা হয়েছে। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে অগুন দেওয়া হয়েছে। শামীম আখতার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও তাকে ছেড়ে দিতে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পুলিশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিরপুরে অবস্থানরত অবাঙালিরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত বিভিন্ন মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগনের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।
২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সাথে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে ১০০ জন নিহত হয় এবং ১০০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং আবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়।
রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাক সেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে।এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু আহত হয়।
চট্টগ্রামে পাক সেনারা নৌ-বন্দরের ১৭ নং জেটিতে নোঙর করা এম.ভি.সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে।সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২ টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথ রোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ২০০ জন শ্রমিক শহীদ হন।
মিরপুরে অবাঙালিরা সাদাপোশাকধারী পাকসেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। দু’ঘন্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তাঁর ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।
পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগনের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখন্ড রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত।
টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা টিভির সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরো জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার ব্যাপক জনগনের প্রতি আহ্বান জানান।
সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।