উত্তাল ২৭ মার্চ ১৯৭১ঃ ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার খবরে প্রতিরোধের এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে ময়মনসিংহের বাঙালি ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ২৭ মার্চ রাতে ময়মনসিংহের শহরতলি খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে পাকিস্তানি ইপিআর কর্মকর্তাদের পরিকল্পিত বাঙালি হত্যার ছক পাল্টে দেয় তারা। এটাই ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং বিজয়ের ইতিহাস। এই গৌরবময় বিজয়ের সঙ্গে ময়মনসিংহের ২৫ সহস্রাধিক জনতা যুক্ত ছিল এবং ২৫ দিন ময়মনসিংহ মুক্ত ছিল। পরে পাকিস্তানি বাহিনী রেল ও সড়কপথে কয়েকটি স্থানে স্বাধীনতাকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ময়মনসিংহে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান ২৬ মার্চ ভোরে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার বাসভবনে যান এবং বঙ্গবন্ধুর তারবার্তায় পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের বিষয়টি মাইকে ঘোষণা করা হয় এবং ধারাবাহিক অসহযোগ ও প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়। এ ঘোষণায় হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ শহরতলি খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় তৎকালীন ছাত্রনেতা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার বিষয়টি জেনে তৎকালীন বাঙালি ইপিআর সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ হারুন অর রশিদ বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এদিকে ২৬ মার্চ বিকেল ৩টায় ইপিআর উইং কমান্ডার কমর আব্বাস বাঙালি ইপিআর সদস্যদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ নিয়ে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সন্দেহের সূত্র ধরে শেখ হারুন বাঙালি ইপিআর সদস্য নান্নু, আফতাব, জয়নাল, কাজী সাঈদসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে অস্ত্র জমা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন। এ সিদ্ধান্ত গোপনে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের জানানো হয়। অস্ত্র জমা না দেওয়ায় ইপিআর উইং কমান্ডার কমর আব্বাস ২৭ মার্চ দুপুরে ক্যাম্পে বড় খানার আয়োজন করেন এবং বাঙালি ইপিআর সদস্যদের একসঙ্গে জমায়েতের মাধ্যমে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনাও বাঙালি ইপিআর সদস্যরা আঁচ করতে পেরে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে খানায় অংশ নেন। এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ইপিআরের উইং কমান্ডার কমর আব্বাস পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যের পরিবর্তে ইপিআর কমান্ডার ওমর জান ও খটক নামে দুই কর্মকর্তাকে যুদ্ধবেশে ক্যাম্প এলাকায় নজরদারির দায়িত্ব দেন। এতে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
২৭ মার্চ রাতে টহলরত ওই দুই পাকিস্তানি ইপিআর কর্মকর্তা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। শেখ হারুনসহ তার সহযোগীরা ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে সজাগ ছিলেন। রাত ১২টা ৮ মিনিটে হঠাৎ রাইফেলের গুলিতে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এর পরই ব্যারেলের পিস্তল দিয়ে সবুজ রঙের ফায়ার করে বাঙালি ইপিআর হত্যা ও আক্রমণের সংকেত দেওয়া হয়। নিশ্চিত আক্রমণের সংকেত শুনে শেখ হারুন সহযোগীদের পাল্টা আক্রমণে প্রস্তুত হতে বলতেই নান্নু গুলি চালান। এ গুলিতে টহলরত পাকিস্তানি দুই ইপিআর কর্মকর্তা মারা যায়। এর পরই বাঙালি ইপিআর সদস্যরা ক্যাম্পের মাঠে রাখা ১২টি জিপে এলএমজি দিয়ে আক্রমণ চালায়। এর পর থেকেই পাকিস্তানি ইপিআর ও বাঙালি ইপিআর সদস্যদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রাতভর যুদ্ধে বেশিরভাগ পাকিস্তানি ইপিআর সদস্য মারা যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ২৮ মার্চ ভোররাতে উইং কমান্ডার কমর আব্বাস তার বাসভবন এলাকায় প্রায় ২০ জন কমান্ডার নিয়ে কাউন্টার আক্রমণ শুরু করেন। ওই সময় শেখ হারুনসহ ছয়জন প্রতিরোধের জন্য অবস্থান নেন। গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে বাঙালি ইপিআর দেলোয়ার গুলিতে শহীদ হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে উইং কমান্ডার কমর আব্বাসসহ তার সহযোগীরা পিছু হটে। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের রেললাইনের পাশ দিয়ে কমর আব্বাস ও তার সহযোগীরা খাগডহর রেললাইন এলাকার ঘুমটিঘরের কাছে পেঁৗছলে ইপিআর সদস্য ও সাধারণ মানুষ তাদের ঘেরাও করে ফেলে। এক পর্যায়ে কমর আব্বাস আত্মসমর্পণ করলেও বিক্ষুব্ধ মানুষের রোষানলে পড়ে তার মৃত্যু হয়। পাকিস্তানি ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি ইপিআর সদস্যের প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রায় ১২১ জন পাকিস্তানি ইপিআর সদস্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে ছয়জন বাঙালি ইপিআর সদস্য শহীদ হন বলে জানা যায়।
বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কেএম শামসুল আলম। একাত্তরে তিনি পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি জানান, আমি ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ২৮ মার্চ ভোররাতে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করি। বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধে ২৮ মার্চ পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের হাত থেকে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প মুক্ত হয়।
খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ বাঙালি ইপিআর সদস্যের হাতে চলে আসার পর ২৮ মার্চ দুপুরে ক্যাম্পে আসেন মেজর কেএম সফিউল্লাহ (পরে সেনাপ্রধান)। তখন তার নির্দেশেই জেলখানায় আটক ১৭ জন পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যকে বের করে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা মো. হাফিজুর রহমান একাত্তরে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বিএ চূড়ান্ত পর্বের ছাত্র ছিলেন। ২৮ মার্চ খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের প্রতিরোধে ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজসহ অনেকেই তিন দিনের কোর্স সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহে প্রবেশের আগ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকার কারণে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহে প্রবেশ করতে পারেনি। তবে ১৯ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা দেয়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস আলম রেলপথ প্রতিরোধে অংশ নেন। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের ময়মনসিংহের সীমানা কাওরাইদ এলাকায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনী অংশ নেয়। এখানে সে সময়ে পুলিশে কর্মরত এবিএম আবদুস সবুর শহীদ হন। ২১ এপ্রিল ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের কালীরবাজার এলাকায় পেঁৗছলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে যায়। পরে পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেন থেকে নেমে গুলি করতে করতে রেললাইনের দু’পাশের বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে। তখন পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। বিকেলে তারা ময়মনসিংহ শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
অন্যদিকে সড়কপথে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী অগ্রসর হলে টাঙ্গাইলের কালীহাতি ও মধুপুরে বাধার মুখে পড়ে। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা সেলিম সাজ্জাদসহ কেএম শামসুল আলম, আবদুল হাসেম, নজরুল ইসলাম দুলাল, সাবেক এমপি শামসুল হক অংশ নেন। ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভারী সমরাস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হওয়ায় তেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে খণ্ড খণ্ডভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী নিরাপদে ময়মনসিংহে অবস্থান নেওয়ার জন্য ২১ ও ২২ এপ্রিল বিমান হামলা চালায়। বোমা বিস্টেম্ফারণের ঘটনায় ময়মনসিংহবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত ময়মনসিংহবাসী গ্রামাঞ্চলে চলে যায়। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহে ঢোকার পর খালি হয়ে যায় ময়মনসিংহ শহর।
তথ্য সূত্রঃমুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রতিবেদন।
লেখকঃমোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।